আইন-আদালত

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের হাইকোর্টের রায় খারিজ: আপিল বিভাগের রায়

রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন আপিল বিভাগ। নির্বাচন কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রবিবার এই রায় দেন। সর্বোচ্চ আদালত তার আদেশে বলেছেন, জামায়াতের নিবন্ধন চেয়ে যে আবেদন করা আছে, সেটিসহ অন্য কোনো বিষয় থাকলে সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) তাদের সাংবিধানিক এখতিয়ার অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


গত ১৪ মে আপিল বেঞ্চ এই রায়ের দিন ধার্য করেছিলেন। আদালতের আজকের শুনানিতে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক, ইমরান এ সিদ্দিক ও মোহাম্মদ শিশির মনির। অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম। সর্বোচ্চ আদালত প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে জামায়াতের আবেদনের বিষয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ দেননি, যা ভবিষ্যতে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে।


জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে মামলার ক্রমধারা:

  • ২০০৮: নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াতসহ ৩৮টি দলের নিবন্ধন।
  • ২০০৯: জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২৫ জনের রিট, হাইকোর্টের রুল জারি।
  • ২০১৩, ১ আগস্ট: হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায়, জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা। কারণ: সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে। সে সময় ৩৮টি দলকে নিবন্ধন দেওয়া হয়, যার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র নিবন্ধিত দলগুলোই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। নিবন্ধন দেওয়ার পরের বছর, অর্থাৎ ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন।

এই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেন। রুলে জানতে চাওয়া হয়, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না। রুল জারির পর নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে জামায়াত। কিন্তু চূড়ান্ত শুনানির পর সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। সংবিধানের সঙ্গে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় ওই রায়ে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয়।


হাইকোর্টের রায়ের পর জামায়াত আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে। কিন্তু ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সেই আবেদন খারিজ করা হয়। এরপর ওই বছর ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভটু আপিল করে জামায়াতে ইসলামী, যা পরে আপিল হিসেবে গণ্য করা হয়। হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করার পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। হাইকোর্টের রায়ের পর দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশ নিতে পারেনি জামায়াতে ইসলামী।


গত বছর ৬ নভেম্বর সর্বোচ্চ আদালত এক আদেশে দলটির আপিল শুনানির সিদ্ধান্ত নেন এবং ১২ নভেম্বর তারিখ রাখেন। সেদিন জামায়াতের মনোনীত আইনজীবীর পক্ষে সময় চাওয়া হলে আপিল বিভাগ শুনানি পিছিয়ে দেন। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর জামায়াতের আপিলটি শুনানিতে ওঠে। সেদিন জামায়াতের পক্ষে কোনো আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় সর্বোচ্চ আদালত আপিলটি খারিজ করে দেন। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দলটি খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেয়। গত বছর ৩১ আগস্ট আপিল পুনরুজ্জীবিত (রিস্টোরেশন পিটিশন) করতে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে জামায়াত। গত ২২ অক্টোবর সেই আবেদন মঞ্জুর করেন সর্বোচ্চ আদালত।


গত ৩ ডিসেম্বর থেকে পুনরুজ্জীবিত আপিলের শুনানি শুরু হয়। এর মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে একটি আবেদন করেছিল জামায়াত। গত ১৪ মে চূড়ান্ত শুনানির পর সেই আবেদন প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলেন জামায়াতের আইনজীবী। অবশেষে আজ আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বাতিল করে রায় দিলেন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker