নওগাঁ

নওগাঁর গোয়ালবাড়ি গ্রাম পুরুষশূন্য: জোড়া খুনের মামলায় গ্রেফতার আতঙ্ক

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় জোড়া খুনের মামলায় ১০০০-১২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করার পর নওগাঁর আত্রাই উপজেলার গোয়ালবাড়ি গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। পুলিশের হয়রানি ও গ্রেফতার আতঙ্কে তিন মাসের বেশি সময় ধরে গ্রামের পুরুষরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার রনশিবাড়ি বাজার এলাকায় এক মাছ ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাতে হত্যার পর গণপিটুনিতে হত্যাকারীও নিহত হন। এ ঘটনায় ১ হাজার থেকে ১২শ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়েরের পর থেকে গ্রেফতার আতঙ্কে নওগাঁর আত্রাই উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি গ্রামটি প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে

অভিযোগ উঠেছে, আসামি অজ্ঞাত হওয়ার সুযোগে বাগমারা থানা পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত নয় এমন নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার করছে। এতে আতঙ্কে গ্রামটির অধিকাংশ পুরুষ সদস্যরা তিন মাসের বেশি সময় ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

জোড়া খুনের ঘটনা ও মামলার বিবরণ

মামলার এজাহার ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরের ৪ এপ্রিল বিকেলে গোয়ালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মাছ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাককে (৩৫) ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন একই গ্রামের বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম (২৫)। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গোয়ালবাড়ি গ্রামের পার্শ্ববর্তী রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার রনশিবাড়ি বাজারে। সেদিন রনশিবাড়ি বাজারে হাটের দিন ছিল। আমিরুল জনসম্মুখে ছুরিকাঘাত করে মাছ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাককে হত্যা করেন।

এ ঘটনার পর লোকজন উত্তেজিত হয়ে পড়লে আমিরুল নিজের প্রাণ বাঁচাতে রনশিবাড়ি গ্রামের একটি বাড়িতে ঢুকে পড়েন। খবর পেয়ে বাগমারা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে রাত ৮টার দিকে ওই বাড়ি থেকে আমিরুলকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এসময় পুলিশ স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে পড়ে। এক পর্যায়ে উত্তেজিত লোকজন আমিরুলকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে।

এ ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে হত্যার অভিযোগে বাগমারা থানার ভাগনদী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের উপ-পরিদর্শক মো. গণি চৌধুরী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ১ হাজার থেকে ১২শ জনকে আসামি করে মামলা করেন। এছাড়া মাছ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক হত্যার ঘটনায় তার ভাই একরামুল প্রামাণিক বাদী হয়ে বাগমারা থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলার একমাত্র আসামি আমিরুল ইসলাম মারা যাওয়ায় চার্জশিট দাখিলের আগেই মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। জোড়া খুনের ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক তৈরি হয়। পুলিশ বাদী হয়ে করা মামলায় অভিযান চালিয়ে এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। গ্রেফতার ব্যক্তিরা সবাই আত্রাই উপজেলার গোয়ালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা।

গ্রামবাসীর অভিযোগ ও দুর্ভোগ

গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাছ ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা আমিরুল ইসলাম একজন মাদকাসক্ত যুবক ছিলেন। মাদক কেনার জন্য টাকা না পেয়ে মানুষকে মারধর করার অনেক অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। গোয়ালবাড়ি ছাড়াও আশপাশের গ্রামের লোকজন তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। বাজারের মধ্যে মাছ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার ঘটনার জেরে বাজারে থাকা লোকজন উত্তেজিত হয়ে গণপিটুনি দিলে তার মৃত্যু হয়।

পরে পুলিশ অজ্ঞাতনামা ১ হাজার থেকে ১২শ জনকে আসামি করে মামলা করেন। আসামি অজ্ঞাত হওয়ার সুযোগে বাগমারা থানা পুলিশ মাঝে মাঝেই গোয়ালবাড়ি গ্রামে আসামি ধরার নামে কয়েক দফা অভিযান চালিয়েছে। গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে ঘটনায় জড়িত নয়, এমন নিরীহ মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দিচ্ছে পুলিশ। ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন, আবার গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচাতে গেছেন এমন লোককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুলিশ কখন, কাকে গ্রেফতার করে, সেই আতঙ্কে গ্রামটির অধিকাংশ পুরুষ সদস্যরা তিন মাসের বেশি সময় ধরে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) গোয়ালবাড়ি গ্রামের গোয়ালবাড়ি বাজার এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে তেমন লোকজন নেই। বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এগিয়ে আসেন কিছু পুরুষ ও নারী। এসময় তারা জানান, গোয়ালবাড়ি বাজার থেকে প্রায় ৩০০মিটার দূরে রনশিবাড়ি বাজারে জোড়া খুনের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় ১২শ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া দুই ব্যক্তির বাড়ি গোয়ালবাড়ি গ্রামে। মামলার পর থেকেই পুলিশ আসামি ধরতে গোয়ালবাড়ি গ্রামে হানা দেওয়ায় মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। গ্রেফতারের ভয়ে গ্রামটির স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, তরুণ ও পুরুষ সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে আছে। গ্রামটিতে বসবাসকারী অধিকাংশ দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। অথচ তিন মাস থেকে পুরুষরা ঘর ছাড়া। নেই রোজগার। খেয়ে না খেয়ে চলছে সংসার।

গোয়ালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন (৭০) বলেন, “আমার ছেলে আব্দুল আওয়াল (১৮) এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। দুই মাস হলো র‌্যাব সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। জামিন না পাওয়ায় এবার এইচএসসি পরীক্ষায় সে অংশ নিতে পারলো না। অথচ আমার ছেলে ওই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। ওই দিন বিকেলে আব্দুর রাজ্জাককে হত্যার পর বিকেলে সে বাজারে দেখতে গিয়েছিল। লাশ দেখে তার খারাপ লাগায় কিছুক্ষণ পরেই সে বাড়িতে চলে আসে। রাজ্জাকের লাশ দেখার সময় একটা ভিডিওতে আমার ছেলেকে দেখতে পাওয়া যায়। ওই ভিডিও দেখে আমার ছেলেকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু ওই দিন রাত ৮টার দিকে আমিরুল গণপিটুনিতে মারা যায়। তখন আমার ছেলে বাড়িতে ছিলো। তাকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করেছে। আমার বড় ছেলেও গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”

বুলজান বিবি নামের এক নারী বলেন, “হত্যাকান্ডের ঘটনার দিন আমার ছেলে বিয়ের দাওয়াত খেতে আত্রাইয়ে গিয়েছিল। ওই দিন সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে রনশিবাড়ি বাজারে গন্ডগোলের কথা শুনতে পেয়ে সেখানে যায়। আমিরুলকে যখন শত শত মানুষ মারধর করছিল তখন আমার ছেলে তাকে বাঁচানার চেষ্টা করছিল। এলাকার লোকজনই এই সাক্ষী দেবে। অথচ র‌্যাব সদস্যরা আমিরুলকে হত্যার ঘটনায় আমার ছেলেকেই গ্রেফতার করেছে।”

সুইটি বেগম নামে আরেক নারী বলেন, “আমার ছেলে রাজ মিস্ত্রীর কাজ করে। প্রতিদিন সকালে বের হয়ে যায় সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে। আমার ছেলে হত্যার সাথে জড়িত ছিলো না। তারপরও আমার ছেলে তিন মাস থেকে পালিয়ে আছে। আমার ছেলে কাজ না করলে সংসার চলে না। এই মুহূর্তে আমাদের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সমিতি থেকে কিস্তি নেওয়া আছে। কিস্তির অফিসার বাড়িতে আসলে টাকা দিতে পারি না।”

গোয়ালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, “আমার ছোট ভাই গোলামকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আমিও গ্রেফতার আতঙ্কে গত তিন মাস ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা দুই ভাই বাড়িতে না থাকায় আমার বোরো ধান ও ভুট্টা খেত থেকে কাটতে পারায় খেতেই নষ্ট হয়ে গেছে। আমন ধানও রোপণ করতে পারছি না।”

গোয়ালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, “রনশিবাড়ি বাজারে শুক্রবার হাটবারের দিন আশপাশের ১০-১২ গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ থাকে। আব্দুর রাজ্জাক ও আমিরুল যেদিন খুন হয় সেদিনও হাজার হাজার লোক বাজারে ছিল। পুলিশের কাছ থেকে আমিরুলকে ছিনিয়ে নিয়ে মারধর করে হত্যার সময় শুধু গোয়ালবাড়ি গ্রামের লোকজন সেখানে ছিল না। অন্য গ্রামের লোকজনও ছিল। অথচ পুলিশ শুধু গোয়ালবাড়ি গ্রামের লোকজনকে গ্রেফতারের জন্য বার বার অভিযান চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কেবল তাদেরকে ধরা হোক। নিরীহ মানুষকে যেন হয়রানি করা না হয়।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “রনশিবাড়ি বাজারে ৪ এপ্রিল পুলিশের কাছ থেকে আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এসময় কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও আহত করা হয়। এই ঘটনায় অজ্ঞাতনামা ১ হাজার থেকে ১২শ আসামি করা হলেও এখন পর্যন্ত আমরা ৫ জন আসামিকে গ্রেফতার করেছি। ঘটনার দিনের ভিডিও দেখেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। কোনো নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে না।”

নওগাঁর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাফিউল সারোয়ার বলেন, “ঘটনাটি নওগাঁ জেলা পুলিশের আওতায় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের বাড়ি আমাদের আওতায়। তারপরও যাতে নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হয় সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।”

Author

মো: খালেদ বিন ফিরোজ, নওগাঁ প্রতিনিধি

পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি ৩০ মে থেকে মিশন ৯০ নিউজে নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে, সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker