ভূঞাপুর

টাঙ্গাইলে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠেছে অবৈধ বালুঘাট

যমুনার তীর ঘেঁষে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠেছে অবৈধ বালুঘাট। স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রীয়তা ও নগদ টাকার প্রলোভনে স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ওইসব বালুঘাটের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নদীতীর রক্ষাবাঁধ বর্ষা মৌসুমে ভেঙে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং সরকারের ইকোনোমিক জোন তৈরির প্রস্তাবিত প্রকল্প ভেস্তে যাচ্ছে। এলাকাবাসী বালুঘাট বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।

জানা যায়, যমুনা নদীর বালু স্থানীয়দের কাছে সাদাসোনা হিসেবে খ্যাত। আওয়ামীলীগের শাসনামলে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের নিকরাইল ও গোবিন্দাসী ইউনিয়নে অবৈধ বালুঘাট ছিল ১৯টি। এসব বালুঘাট উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র মাসুদুল হক মাসুদ এবং সাবেক এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির নিয়ন্ত্রণ করতেন।

অন্যদিকে, অর্জুণা ও ফলদা ইউনিয়নে বালুঘাট ছিল ৩টি। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল ইসলাম তোতা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতনের পর আওয়ামীলীগের নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। ওইসব বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় স্থানীয় বিএনপি নেতাদের হাতে।

১৯টি অবৈধ বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিএনপি নেতারা আরও ১৪টি অতিরিক্ত বালুঘাট বসায়। তাহেরুল ইসলাম তোতার নিয়ন্ত্রণাধীন ৩টি বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ওই এলাকায় আরও ২টি নতুন বালুঘাট বসায় স্থানীয় ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেন ওরফে সুইট, মোজাম্মেল হোসেন ও যুবদল নেতা টিপু।

বর্তমানে ভূঞাপুর উপজেলায় ৩৩টি ও ৫টি মোট ৩৮টি অবৈধ বালুঘাট চলছে। প্রতিটি বালুঘাটে রয়েছে ৩-৪টি করে বালু তোলার পয়েন্ট। যেগুলো থেকে বালু কেটে ট্রাকে তোলা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, নিকরাইল ও গোবিন্দাসী ইউনিয়নের ৩৩টি অবৈধ বালুঘাট ভূঞাপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিমুজ্জামান তালুকদার সেলুর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তিনি উপজেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ মো. সোলায়মান হোসেন ওরফে লিটন মন্ডল, নিকরাইল ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডলকে নিয়ে অবৈধ বালুঘাটগুলো পরিচালনা করছেন।

তারা ৩৩টি অবৈধ বালুঘাটকে ৬ ভাগে ভাগ করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এছাড়া ভূঞাপুর-তারাকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ফলদা ইউনিয়নের কুঠিবয়ড়া, অর্জুনা ইউনিয়নের অর্জুনা, তারাই, জগৎপুরা ও নলিন এলাকার ৫টি বালুঘাটের নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেন ওরফে সুইট, মোজাম্মেল হোসেন ও যুবদল নেতা টিপু।

সরেজমিনে দেখা যায়- নিকরাইল ইউনিয়নের নিকরাইল, মাটিকাটা, সিরাজকান্দী, জিগাতলা এলাকায় ২৪টি এবং গোবিন্দাসী ইউনিয়নে ৯টি বালুঘাট রয়েছে। বালুঘাটগুলো নিয়ন্ত্রণে ৬টি গ্রপ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম গ্রপের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন নিকরাইল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গী হোসেন মন্ডলের ছোট ভাই বিএনপি নেতা আলম মন্ডল, ইউনিয়ন তাঁতী দলের সাধারণ সম্পাদক মো. হাসমত প্রামানিক, উপজেলা বিএনপির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সরকার শরীফ।

দ্বিতীয় গ্রæপের নেতৃত্বে রয়েছেন- উপজেলা যুবদলের যুগ্ম-আহবায়ক মো. রাজিব হোসেন তালুকদার কফিল, মো. মোহসিন তালুকদার দিপু, মো. আসলাম মেম্বার। তৃতীয় গ্রæপের দায়িত্বে রয়েছেন- ভূঞাপুর পৌর বিএনপির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, সাধারণ সম্পাদক খন্দকার লুৎফর রহমান গিয়াস।

Image

চতৃর্থ গ্রপে রয়েছেন- বিএনপি নেতা মো. আসলাম, মো. হাসেম প্রামানিক, আব্দুল লতিফ। পঞ্চম গ্রæপে রয়েছেন, বিএনপি নেতা আকবর প্রামাণিক, মুজাফফর প্রামাণিক, মো. আলম মন্ডল। ষষ্ঠ গ্রপের দায়িত্বে রয়েছেন- গোবিন্দাসী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. হাফিজুর রহমান শাহিন, সাধারণ সম্পাদক মাকছুদ জামিল মিন্টু।

স্থানীয় একাধিক বালু ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করে জানায়, ৩৩টি বালুঘাটের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছ থেকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা উঠিয়ে মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত চার নেতা নিজেদের কাছে জমা রেখেছেন। জমাকৃত ওই টাকা থেকে ৭৯ লাখ টাকায় স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অবৈধ বালুঘাট পরিচালনা করা হচ্ছে। জমাকৃত অবশিষ্ট টাকা আপদকালীন সমস্যা নিরসনের জন্য রাখা হয়েছে।

স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে জানায়, যেভাবে অবৈধ বালুঘাট বসিয়ে দিন-রাত বালু বিক্রি করা হচ্ছে তাতে এ এলাকায় সরকার প্রস্তাবিত ইকোনোমিক জোন প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বালুখেকোরা ইকোনোমিক জোনের জন্য অধিগ্রহণকৃত জায়গা থেকেও বালু বিক্রি করছে।

অন্যদিকে, ভূঞাপুর-তারাকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কের উপজেলার ফলদা ইউনিয়নের কুঠিবয়ড়া, অর্জুণা ইউনিয়নের অর্জুণা, তারাই, জগৎপুরা ও নলিন এলাকার ৫টি স্থানে যমুনা নদীতে বাঁধ দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাইডবাঁধ(তীররক্ষা বাঁধ) ভেঙে গাড়ি চলাচলের রাস্তা তৈরি করে নদীর চর কেটে বালু বিক্রি করছে।

তারাই গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক রজমান আলী ও সিফাত আহমেদ সহ অনেকেই জানান, যেভাবে দিন-রাত ভেকু মেশিন(খননযন্ত্র) দিয়ে বালু কেটে ট্রাকযোগে বিক্রি করা হচ্ছে তাতে আগামি বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙনে ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাবে। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নদীরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। একাধিকবার তারা প্রতিবাদ ও অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পান নি।

বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার(৩ ডিসেম্বর) দুপুরে উপজেলার বলরামপুর, তারাই ও গারাবাড়ি এলাকার লোকজন ভূঞাপুর-তারাকান্দি আঞ্চলিক মহাসড়কের গারাবাড়ী এলাকায় আগুন জ¦লিয়ে প্রায় ২ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। এতে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ খরব পেয়ে ভূঞাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফাহিমা বিনতে আখতার ও থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) একেএম রেজাউল করিম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বালু উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ তুলে নেয়।

এরআগে গারাবাড়ী এলাকায় স্থানীয়দের আন্দোলন চলাকালে অবৈধ বালুঘাটে গিয়ে এলাকাবাসী বালু উত্তোলনের বেশ কয়েকটি ভেকু (খননযন্ত্র), একটি ড্রামট্রাক ও বেশকিছু পাইপ ভাঙচুর করে। পরে পাইপগুলো মহাসড়কে নিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

এদিকে, ভূঞাপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিমুজাম্মান তালুকদার সেলু জানান, তিনি বালুঘাটের সঙ্গে জড়িত নন। তার নাম ভাঙ্গিয়ে বিএনপির লোকজন ঘাটগুলো পরিচালনা করছে।

নিকরাইল ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মন্ডল জানান, সকল বালুঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. সেলিমুজাম্মান তালুকদার সেলু এবং তারা তাঁকে সহযোগিতা করেন।

ভূঞাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি) ফাহিমা বিনতে আখতার জানান, বিক্ষোভের খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে বালুঘাট বন্ধের প্রতিশ্রæতি দিয়ে আন্দোলনকারীদের আশ^স্ত করেছেন। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক শরীফা হক জানান, বালু বা ফসলি জমির মাটি কেটে বিক্রি করার কোন সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় অবৈধ বালু উত্তোলন ও ফসলি জমির মাটি কাটা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Author

আব্দুস সাত্তার, বিশেষ প্রতিনিধি

নাম আব্দুস সাত্তার। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি মিশন নাইনটি নিউজের একজন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker