টাঙ্গাইলফুটবল

কৃষ্ণার আয়ে চলে পুরো পরিবার

নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। দেশের হয়ে তিন গোলের মধ্যে দুটোই করেছেন টাঙ্গাইলের কৃষ্ণা রানী সরকার। খেলার ১৩ ও ৪১ মিনিটে গোল করে বাংলাদেশের জয়কে নিশ্চিত করেন তিনি। কৃষ্ণার গোলে একদিকে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বে বাংলাদেশের নতুন একটি ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এ জয়ের আনন্দে ভাসছে পুরো দেশ।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত একটি গ্রামের নাম উত্তর পাথালিয়া। প্রত্যন্ত এই গ্রামে দারিদ্রতার ছাপে জর্জরিত একটি টিনের বাড়ি। অচল পয়সার মতো অবহেলার ছোট এই টিনের বাড়িটি ঘিরেই এখন গর্ব আর ব্যাপক উচ্ছ্বাস। কারণ, এ বাড়িটিই তো সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে জোড়া গোলের মালিক কৃষ্ণা রাণী সরকারের। কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা কৃষ্ণার সাফল্যে দেশবাসীর কাছে সত্যিই আনন্দের।

বাবা বাসুদেব সরকার ও মা নমিতা রানী সরকারের দুই সন্তানের মধ্যে কৃষ্ণা সবার বড়। ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি মায়ের কোলজুড়ে আসে কৃষ্ণা। ছোটবেলা থেকেই খেলা পাগল কৃষ্ণার ভিন্নমাত্রার আকর্ষণ ছিল ফুটবলের প্রতি। সারাক্ষণ ভাইদের সঙ্গে আর গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ফুটবল খেলতো কৃষ্ণা। দিনের বেশির ভাগ সময় খেলা নিয়ে বাড়ির বাইরে থাকতো বলে মা প্রায়ই বকা দিতেন।

লেখাপড়ার প্রতি কিছুটা অমনোযোগী থেকে ফুটবল নিয়ে মাতামাতি করায় একবার কৃষ্ণার মা হাত থেকে বল কেড়ে নিয়ে বকা দিয়েছিলেন।ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তখন কৃষ্ণা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। তা দেখে কৃষ্ণার কাকা একটি ফুটবল কিনে দেন তাকে। পরে আশপাশের মেয়েশিশুদের নিয়ে বাড়ির ছোট আঙ্গিনায় ফুটবল চর্চার সুযোগ মেলে তার। কিন্তু তাতেও কৃষ্ণাকে দমাতে পারেননি বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার ও মা নমিতা রাণী সরকার।

এদিকে ফুটবলে কৃষ্ণার হাতেখড়ি ২০১০ সালে উপজেলা পর্যায়ে বঙ্গমাতা ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিব আন্তঃপ্রাথমিক ফুটবল টুর্নামেন্টে। কৃষ্ণার নেতৃত্বে তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তর পাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই টুর্নামেন্টে কৃষ্ণা সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়ায় সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপনের নজরে পড়েন এ ফুটবল রাজকন্যা।

কৃষ্ণার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখে শরীর চর্চা শিক্ষক অনেকটাই নিজের আগ্রহ নিয়ে কৃষ্ণার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর কৃষ্ণাকে সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলে বিনা বেতনে ভর্তি করানো হয়। আর এ স্কুলে ভর্তি হয়েই ফুটবল চর্চার অবাধ সুযোগ পেয়ে যায় সে।

কৃষ্ণার ফুটবলার হওয়ার পেছনে তার কাকার বেশ অবদান রয়েছে। সকালে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন তিনি। কৃষ্ণার বাবার কাছে তেমন একটা টাকা ছিল না। তাই আসা-যাওয়ার ভাড়াও কাকাই দিতেন। এরপর উপজেলা পরিষদ থেকে সাইকেল দেওয়ার পর অনুশীলনে যেতে তেমন একটা সমস্যা হয়নি।

একসময় দর্জির দোকান ছিল কৃষ্ণার বাবা বাসুদেব সরকারের। টাকার অভাবে অনেক আগেই দোকান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। বর্তমানে অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে দিনাতিপাত করছেন।

পরে গোলপুরের সূতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুল কৃষ্ণার ফুটবল নৈপূণ্য আর বিশেষ ভূমিকায় জাতীয় স্কুল ও মাদরাসা ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১১, ২০১২ এবং ২০১৩ সালে পরপর তিনবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। পরবর্তীতে জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দল গঠন করা হলে কৃষ্ণাসহ একই স্কুল থেকে আরও দুই কিশোরী ফুটবলার বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৪ বালিকা ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক ফুটবলে কৃষ্ণার নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। পরের বছর একই টুর্নামেন্টেও শিরোপা ঘরে তোলে বাংলাদেশ। তবে সেই দলে বয়সের কারণে ছিলেন না কৃষ্ণা। কিন্তু একই বছর ঢাকায় হওয়া এএফসসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইয়ে গ্রুপ পর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই দলের গর্বিত অধিনায়কও ছিলেন কৃষ্ণা রাণী সরকার। একই সঙ্গে সেই আসরে ৮ গোল করে দলকে সামনে থেকেই নেতৃত্ব দেন এ ফুটবল বিস্ময় কন্যা। ২০১৭ সালে কৃষ্ণার নেতৃত্বেই থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের মূল পর্বে খেলার গৌরব অর্জন করেছে লাল-সবুজের দল। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ভারতে হওয়া সাফ ফুটবলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। যে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন কৃষ্ণা।

এদিকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে কৃষ্ণার অভূতপূর্ব সাফল্যে তার নিজ গ্রাম থেকে শুরু করে পুরো টাঙ্গাইলে চলছে উল্লাস। রানীর গ্রামে ফেরার অপেক্ষায় আছে স্থানীয়রা। সোমবার নেপালের কাঠমান্ডুতে খেলা চলাকালীন সময়ে কৃষ্ণা রানীর গ্রামের বাড়িতে চলছিল লোডশেডিং। ফলে কৃষ্ণার মা জোড়া গোল উপভোগ করতে পারেননি। তবে বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার থেমে থাকেননি। দুই মাইল বাইসাইকেল চালিয়ে পাশের গ্রামে গিয়ে টিভেতে খেলা দেখেছেন। গোলের সঙ্গে সঙ্গে টিভির সামনে থাকা দর্শকরা কৃষ্ণার বাবাকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করেছেন।

উল্লাস হবেই না বা কেন। কারণ, কৃষ্ণারাই তো বাংলাদেশকে নতুন করে চেনালেন। প্রমান করেছেন দলের অন্যতম বড় ভরসার নাম কৃষ্ণা রাণী সরকার।

কৃষ্ণার মা নমিতা রাণী সরকার বলেন, আমরা খুবই গরিব। এক সময় টাকার অভাব ও গ্রামের মানুষের কটুকথার কারণে মেয়েকে ফুটবল খেলতে বারণ করেছিলাম। তারপরও কৃষ্ণার ইচ্ছার কাছে কটূক্তি করা মানুষজন হেরে গেছে। সে এখন দেশের গৌরব। সবাই তার প্রশংসা করছে। তবে অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি হচ্ছে না আমাদের। এক মেয়ের ওপর নির্ভর করে সংসার খরচ ও ছেলের পড়াশোনা চলে। কৃষি কাজ করে তেমন আয় হয় না। সরকার বা প্রধানমন্ত্রী পূর্বের ন্যায় আমার মেয়ে এবং আমাদের দিকে সুনজর দিলে হয়তো অর্থনৈতিকভাবে আমাদের মুক্তি মিলবে।

কৃষ্ণার বাবা বসুদেব সরকার বলেন, ছেলে খেলোয়াড়রা অনেক টাকা বেতন পায়। অথচ মেয়েরা সামান্য সম্মানি পায়। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও দেশসেরা হয়েছে। সুতরাং তাদের কেন ন্যায্য বেতনভাতা দেওয়া হবে না। বাফুফের সভাপতি আমাকে বলেছিলেন, মেয়েরা যেভাবে পরিশ্রম করে সেই অনুযায়ী কোনো কিছু দেওয়া হয় না। আমরা বেতন দিতে পারছি না। হাত খরচের জন্য দেওয়া হয়। কোনো একদিন হয়তো মেয়েরাও ছেলেদের মতো বেতন, গাড়ি-বাড়ি পাবে।’এর আগে খেলাধুলার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে কিছু জমি কেনা হয়েছে। এ ছাড়া থাকার মতো একটা বাড়ি করছি।

সূতি ভিএম মডেল পাইলট হাইস্কুলের শরীর চর্চা শিক্ষক ও কৃষ্ণার হাতেখড়ি কোচ গোলাম রায়হান বাপন বলেন, কৃষ্ণা খুব দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কঠোর পরিশ্রম এবং ইচ্ছা শক্তি থাকার ফলে কৃষ্ণা আজ দেশসেরা ফুটবলার হতে পেরেছে। যা সত্যিই প্রশংসনার দাবি রাখে। তাকে দেখে স্কুল এবং উপজেলার অনেক ক্ষুদে ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায় আগ্রহী হচ্ছে।

গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক বলেন, কৃষ্ণা গোপালপুর তথা পুরো দেশের সুনাম বয়ে এনেছে। আমরা কৃষ্ণাকে নিয়ে গর্ব করি।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker