টাঙ্গাইল

ভূঞাপুরের ৮ গ্রামের মানুষ আতঙ্কে

টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরের নিকরাইল ইউনিয়নে যমুনা নদীর বালু ঘাটে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। গত এক সপ্তায় সংঘর্ষ, হামলা-পাল্টা হামলা এবং ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়ায় দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক আহত হয়েছে। এসব ঘটনায় উভয়পক্ষই থানা ও আদালতে ১০-১২টি মামলা দায়ের করেছে। ফলে ওই এলাকার আট গ্রামের মানুষ চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।

জানা গেছে, নিকরাইল ইউনিয়নের পুনর্বাসন-১, পুনর্বাসন-২, পুনর্বাসন-৩ ও পুনর্বাসন-৪ এবং পলশিয়া, সারপলশিয়া, সিরাজকান্দি, পাটিতাপাড়া গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের মূল ব্যবসা বালু উত্তোলন ও সরবরাহ। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর ওই ইউনিয়নের নির্বাচনে ইউনয়ন আ’লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুল মতিন সরকার নৌকা এবং সাবেক ইউপি সদস্য মাসুদুল হক মাসুদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আনারস প্রতীকে নির্বাচন করেন। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আনারস প্রতীকে মাসুদুল হক মাসুদ চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর পরই বালু ঘাট দখলের চেষ্টায় সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান চেয়ারম্যানের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, হামলা-পাল্টা হামলা এবং ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়।

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের নিকরাইল ইউনিয়নের একটি ঘাটে বালু উত্তোলন করে রাখা হয়েছে।

ওই এলাকায় ১৩টি বালুঘাট রয়েছে। বালু ঘাটগুলো হচ্ছে- নাজির মেম্বারের ঘাট, কদ্দুছ সরকারের ঘাট, ভাবীর ঘাট, মাসুদ মেম্বারের ঘাট, নুহু মেম্বারের ঘাট, করিম মেম্বারের ঘাট, বাগানবাড়ী ঘাট, মুক্তিযোদ্ধা ঘাট, মিনহাজ মন্ডলের ঘাট, ছানোয়ারের ঘাট, বাবুর ঘাট, তাঁতি লীগের ঘাট এবং চিতুলিয়াপাড়া ঘাট। এক সময় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বাসেক) কাছ থেকে ডাব (পুকুরের পার) ইজারা নিয়ে ও জমির মালিকদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এলাকার লোকদের সাথে নিয়ে ওইসব বালুঘাট পরিচালনা করতেন। বাসেক ডাব ইজারা দেওয়া বাতিল করায় জমির মালিকদের সাথে বালু ব্যবসার হিস্যা দেওয়ার চুক্তি কিংবা অংশীদারিত্ব দিয়ে স্থানীয় লোকজন রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

বালু ঘাটগুলোর মধ্যে করিম মেম্বারের ঘাট, বাগানবাড়ী ঘাট, মুক্তিযোদ্ধা ঘাট ও মিনহাজ মন্ডলের ঘাট সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুল মতিন সরকার স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে পরিচালনা করেন। অন্য বালুঘাটগুলো বর্তমান চেয়ারম্যান মাসুদুল হক মাসুদ (সাবেক মেম্বার) তার নেতাকর্মীদের নিয়ে পরিচালনা করেন। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মতিন সরকারের নেতাকর্মীদের বালুঘাট চারটি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।

টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের নিকরাইল ইউনিয়নের একটি বালুঘাটে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষের একটি অংশ।

সিরাজকান্দি গ্রামের বাবলু মিয়া, পলান শেখ, পলশিয়া গ্রামের আবু বক্কর সিদ্দিক, মোখলেছুর রহমান, অটোভ্যান চালক আলামিন, আব্দুর রহিম, সিরাজকান্দি বাজারের খোদাবক্সসহ স্থানীয়রা জানান, বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানের মধ্যকার বিরোধ মূলত: ইউপি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে। বর্তমান চেয়ারম্যান মাসুদুল হক মাসুদ মনে করেন সাবেক চেয়ারম্যানের ইন্দনে তাকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আ’লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুল মতিন সরকার মনে করেন, ভূঞাপুর উপজেলা আ’লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র মাসুদুল হক মাসুদের ইন্দনে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে মাসুদুল হক মাসুদ বালুঘাট দখলে নিতে হামলা চালাচ্ছে। উভয় পক্ষের এহেন ঘটনায় এলাকার মানুষ বাইরে বের হতে পারছেনা। তারা আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। বাজারে যেতে পারছেনা, কোন রকমে গেলেও দোকানপাট খুলতে পারছেনা। অনেকেই ভিন্ন স্থানে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে ভ্যান-অটোরিকশা থামিয়ে মারপিট করা হচ্ছে। তারা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ২৭ মে (শুক্রবার) দুপুরে পাটিতাপাড়া এলাকায় সাবেক চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণাধীন মিনহাজ মন্ডলের ঘাটে বালু তোলা হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ঘাট দখলে নিতে বর্তমান চেয়ারম্যানের লোকজন ওই ঘাটে হামলা চালায়। পাশের মোজাফ্ফর প্রামানিক ও ফেরদৌস প্রামানিকের বাড়ি থেকে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে ও লাঠি সরবরাহ করা হয়। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের ৩০-৩৫জন আহত হয়।

২৯ মে (রোববার) সাবেক চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণাধীন বাগানবাড়ী বালুঘাট বর্তমান চেয়ারম্যানের ভাই রফিক ও নুহু মেম্বার ভূঞাপুর পৌর মেয়র মাসুদুল হক মাসুদের গাড়ি চালক আ: আলিম ও এপিএস পাভেলের উপস্থিতিতে দখল করতে যায়। এ সময় দুই পক্ষের লোকদের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাশের নেংড়া বাজারে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের ২৫-২৬ জন আহত হয়। ৩০ মে (সোমবার) ওই দখলকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া হয়। ৩১ মে (মঙ্গলবার) বতমান চেয়ারম্যানের সমর্থক জুরান মন্ডল ও নুহু মেম্বারের নেতৃত্বে ১৫-২০ জন সমর্থক বাগানবাড়ী বালুঘাট দখল করতে যায়। এ সময় সাবেক চেয়ারম্যানের সমর্থকদের পাল্টা হামলায় উভয় পক্ষে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১০-১২ জন আহত হয়। ১ জুন (বুধবার) ভাবীর ঘাট দখলকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষে ধাওয়া- পাল্টা ধাওয়া হয়।

উল্লেখিত ঘটনায় গত এক সপ্তাহে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক ও টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একই ঘটনায় পাল্টা- পাল্টি অভিযোগ এনে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। ওই ঘটনাগুলোয় ভূঞাপুর থানা ও টাঙ্গাইলের আদালতে ১০-১২টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। ওই ইউনিয়নে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। বর্তমানে এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।

নিকরাইল ইউপি চেয়ারম্যান মাসুদুল হক মাসুদ জানান, বালুঘাট কেউ কারোটা দখল করছে না। তবে জমির মালিকরা সাবেক চেয়ারম্যান ও তার লোকজনকে জমি না দেওয়ায় তাদের উপর হামলা করা হচ্ছে। প্রত্যেক ঘটনাই পুলিশকে জানানো হয়েছে। আবার হামলার শিকার যারা হয়েছেন তারাও থানায় অভিযোগ দিয়েছে।

নিকরাইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মতিন সরকার জানান, তার নামে কোন বালুর ঘাট নেই। তিনি বালুর ব্যবসাও করেন না। পরিকল্পিতভাবে তাকে নির্বাচনে হারানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মাসুদ চেয়ারম্যান, নুরুল ইসলাম ওরফে নুহু মেম্বার ও জুরান মন্ডলের নেতৃত্বে প্রতিদিনই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন ও হামলা চালানো হচ্ছে। তারা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের এক প্রভাবশালী নেতার ইন্দনে বালু ঘাট দখলে নেওয়াকে কেন্দ্র করে এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

ভুঞাপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম জানান, হামলা- পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষ থেকে দুইটি মামলা দায়ের হয়েছে। দুইটি মামলায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। নিকরাইল এলাকায় আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সকল ধরণের ব্যবস্থাসহ অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পৌর মেয়র মাসুদুল হক মাসুদ জানান, নিকরাইল ইউনিয়নে বালুঘাটকে কেন্দ্র করে হামলা- পাল্টা হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা তাকে কেউ জানায়নি। সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মতিন সরকার ঘাট সংশ্লিষ্ট জমির মালিকদের ন্যায্য হিস্যা না দেওয়ায় এসব ঘটনা ঘটছে।

ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা: ইশরাত জাহান জানান, সমস্যাটি মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে দুই পক্ষের সাথে আলোচনা করে বিষয়টি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker