কিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার মঙ্গলবাড়িয়া লিচুর হাসিতে হাসছে গ্রাম

রসে টইটুম্বুর। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। আকারে বড় অথচ বিচি ছোট। ঠিক যেন রসগোল্লা। সিঁদুরে লাল এই লিচুতে রঙিন এখন মঙ্গলবাড়িয়া গ্রাম। এ লিচুর নাম মুখে আসলেই জিভে পানি এসে যায়।

কিশোরগঞ্জে জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার পৌর এলাকার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত প্রায় ২০০ শত বছরের লিচুর ঐতিহ্য বহনকারী ছোট্ট গ্রাম মঙ্গলবাড়িয়া। এ গ্রামে এ লিচুর স্বাদ নেওয়ার জন্য মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে ভিড় করেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার লিচুরসিক ক্রেতারা। সাধারণত মঙ্গলবাড়িয়া লিচু রপ্তানি হয় ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। গত কয়েক বছর যাবৎ দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে এ লিচুর খ্যাতি।

গ্রামের নামেই লিচুর নাম রাখা হয়েছে ‘মঙ্গলবাড়িয়া লিচু’। রসালো, সুমিষ্ট, সুগন্ধ ও গাঢ় লাল রঙের কারণে এ লিচুর খ্যাতি ছড়িয়ে গেছে দেশের বাহিরেও। অনুকূল আবহাওয়ায় এবার এ লিচুর ফলনও হয়েছে বাম্পার।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামে বাগানেই এ লিচু বিক্রি হয়। প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৬০০ টাকায়। এ বছর চাষিরা বাগানগুলো থেকে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার লিচু বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

মঙ্গলবাড়িয়ার প্রতিটি বাড়ির বসতভিটার বা আঙিনায় গাছে গাছে থোকায় থোকায় লাল রং এর ক্ষুদ্রাকৃতির বিচি, পাতলা চামড়া ও বড় আকৃতির লিচু সবার নজর কাড়ছে। সুস্বাদু ও উন্নত জাতের লিচুর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে।শাঁস মোটা ও রসে ভরপুর এ লিচুর মূল জনপ্রিয়তা তার ঘ্রাণে।

বর্তমানে মঙ্গলবাড়িয়া, কুমারপুর, হোসেন্দী, নারান্দী, তারাকান্দি, জাঙ্গালিয়া, সুখিয়া, ও চন্ডিপাশাসহ উপজেলার সর্বত্রই অধিকাংশ বাড়িতে লিচুর বাগান রয়েছে। তার মধ্যে মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামেই ৭-৮শ’ লিচুর বাগান রয়েছে। প্রতি বছর গাছে মুকুল আসার আগেই বেপারীরা অনেক লিচু গাছ আগাম কিনে নেয়।

তারাকান্দি গ্রামের মাহফুজুর রহমান জানান,গাছে লিচু ধরার পূর্বেই বেপারীরা চুক্তিতে বছরের শুরুতেই গাছ কিনে নেয়।

পাইকাররা এখান থেকে লিচু কিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যায়। এছাড়াও আমেরিকা, জার্মান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদিআরব, কুয়েত, সিঙ্গাপুর ও লন্ডনে বাংলাদেশি প্রবাসীদের কাছে বিভিন্ন মাধ্যমে যাচ্ছে মঙ্গলবাড়িয়ার এ সুস্বাদু লিচু। অধিকাংশ লিচু-বাগানই আগাম বিক্রি হয়ে যায়। পাইকাররা অগ্রিম গাছ কিনে অতিরিক্ত দামে লিচু বিক্রি করে থাকেন। এবারও ভালো দাম পাবেন বলে আশা করেন চাষি ও পাইকাররা। এ জন্য সবার মুখে হাসি।

লিচু চাষী আমিনুল ইসলাম জানান, আমার বাগানে ৫০ থেকে ৬০টি লিচু গাছ রয়েছে। এ বাগান থেকে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। প্রতিবছর বাগানের লিচু বিক্রি করে লাখ টাকার উপরে আয় করেন।

মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের লিচুর প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। এই গ্রাম সারা দেশে এখন লিচুর গ্রাম হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়, প্রায় দুইশ’ বছর ধরে এখানে লিচুর আবাদ হচ্ছে। কারো মতে, সুদূর চীন থেকে এই গ্রামেরই এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম এর বীজ নিয়ে আসেন। তার গাছের লিচু খেয়ে গ্রামের কয়েকজন শখের বশে এ লিচুর আবাদ করেছিলেন। পরে কলম পদ্ধতিতে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এ লিচুর আবাদ।

আবার কারো কারো মতে, গ্রামের মঙ্গল শাহ নামের এক ব্যক্তি ভারতের কোন এক স্থান থেকে লিচুর চারা এনে তার বাড়ির আঙিনায় রোপন করেন। সেখান থেকে অন্যান্য গ্রামবাসী গাছের শাখায় কলম করে লিচু চাষ সম্প্রসারণ করেন। এভাবে ধীরে ধীরে এলাকায় লিচু চাষের প্রসার ঘটে।এমন আরো মতবাদ লক্ষ্য করা যায়।

গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠান, বাড়ির সামনের অংশ, পুকুরপাড়, খেতের আইলসহ সব জায়গায় লিচুগাছ। এখন যেদিকেই তাকানো যায় শুধু লিচু আর লিচু।

জানা যায়,সিজনে প্রতিটি বাড়িতেই লেগে থাকে উৎসবের আমেজ ও স্বজনদের আনাগোনা। বাড়ির সামনে পেতে রাখা হয়েছে চেয়ার। সেখানে বসে গল্প করেণ লিচুগাছের মালিকসহ দূরদূরান্ত থেকে লিচু কিনতে আসা ব্যক্তিরা।

পাকুন্দিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, মঙ্গলবাড়িয়া গ্রামের উৎপাদিত লিচু অত্যন্ত সুস্বাদু। শাঁস মোটা, রসে ভরপুর, গন্ধও অতুলনীয়। পরিবেশ অনুকুল হওয়াতে চলতি বছর বাগানগুলো থেকে লিচু বিক্রি করে চাষীরা ভালো লাভবান হতে পারবেন।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবদুস সাত্তার বলেন, কৃষি বিভাগের পরামর্শে এবার লিচুচাষিরা সময়মতো ওষুধ ব্যবহারসহ গাছ পরিচর্যা করায় বাম্পার ফলন পেয়েছেন। সঠিক দাম ও বেশি লাভ পাওয়ায় এলাকার চাষিরাও লিচু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker