দুটি ভুয়া নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প ব্যবহার করে দেশের অন্যতম ব্যবসায় গোষ্ঠী ট্রান্সকম লিমিটেডের অধিকাংশ শেয়ার হস্তান্তরের দলিল তৈরি করে যৌথ মূলধন কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) দাখিল করা হয়েছিল। আদালতে দেওয়া ডাক বিভাগ ও ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের প্রতিবেদনে এমনটিই উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় অভিযোগ ছিল ট্রান্সকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান ও প্রতিষ্ঠানটির ৫ কর্মকর্তা মিলে এমনটি করেছেন।
ওই দুটি নন-জুডিশিয়ল স্ট্যাম্পে ট্রান্সকম লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ্ হকের ভুয়া স্বাক্ষর ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাজেদুর রহমানের আবেদেনের ওপর শুনানি ছিল আজ বৃহস্পতিবার।
তবে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক শরীফুর রহমানের আদালত ফরেনসিক পরীক্ষার আবেদন মঞ্জুর করেননি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শাযরেহ্ হক রাজধানীর গুলশান থানায় বড় বোন সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় শাযরেহ্ হকের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে প্রতারণার মাধ্যমে ট্রান্সকমের অধিকাংশ শেয়ার দখলে নেওয়ার অভিযোগ করা হয়।
শাযরেহ্ হকের আইনজীবী আমিনুল হক বলেন, ‘আরজেএসসি থেকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যে নথি জব্দ করেছেন, দেখা যায় লতিফুর রহমানের রহমানের স্ত্রী শাহনাজ রহমান ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর তার আইনজীবী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে সিমিন রহমানের নামে অধিকাংশ শেয়ার ট্রান্সফার সংক্রান্ত নথি আরজেএসসিতে দাখিল করেন।
তিনি বলেন, ‘স্ট্যাম্প দুটির সত্যতা নিয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসকের কাছে একটি প্রতিবেদন চান আদালত। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, যে ভেন্ডর থেকে এই স্ট্যাম্প দুটি সরবরাহের তথ্য আছে, সেই ভেন্ডরের লাইসেন্স ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর বাতিল করা হয়। আর ২০২০ সালে কোভিড থাকায় ওই ভেন্ডর কোনো স্ট্যাম্প উত্তোলন বা রেজিস্ট্রার জমা করেনি।’
তবে স্ট্যাম্প দুটি কবে নাগাদ অবমুক্ত করা হয়েছিল সেটি জানার জন্য ডিসি অফিস বাংলাদেশ ডাক বিভাগের সহকারী নিয়ন্ত্রকের (স্ট্যাম্প) কাছ থেকে একটি প্রতিবেদন নিতে আদালতকে পরামর্শ দেয়।
তার ভিত্তিতে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ২ ডিসেম্বর ডাক বিভাগের সহকারী নিয়ন্ত্রক (স্ট্যাম্প) শুভ্র সুত্রধরের আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, স্ট্যাম্প দুটি ২০২৩ সালের মে মাসে দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেডের কাছ থেকে সহকারী নিয়ন্ত্রক (স্ট্যাম্প) কর্তৃক গ্রহণ করা হয়েছিল।
শাযরেহ্ হকের আইনজীবী আমিনুল হক বলেন, ‘মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সাজেদুর রহমান ওই দুটি স্ট্যাম্পে শাযরেহ্ হকের যে স্ক্যান করা স্বাক্ষর ব্যবহার হয়েছে, সেটির ফরেনসিক পরীক্ষার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু আদালত বলেছেন, যেহেতু স্ট্যাম্প দুটি ভুয়া তাই আর ফরেনসিক পরীক্ষার প্রয়োজন নেই।’
সিমিন রহমানের আইনজীবী সিদ্দিক উল্লাহ মিয়া বলেন, ‘মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে ২০২০ সালে স্ট্যাম্প ব্যবহার করে শেয়র ট্রান্সফারের দলিল করা হয়েছে। কিন্তু জিপিও’র প্রতিবেদন বলছে, এই দুটি স্ট্যাম্প ২০২৩ সালের।
ফলে সিমিন রহমানের ওপর যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটি ভিত্তিহীন।’
ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে ট্রান্সকমের অধিকাংশ শেয়ার দখলের মামলায় লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ্ হক বলেছেন, ‘আমার বাবা মৃত লতিফুর রহমান তার জীবদ্দশায় ট্রান্সকম লিমিটেডের ২৩ হাজার ৬০০টি শেয়ারের মালিক থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ১ জুলাই মারা যান। আমিসহ অন্যান্য উত্তরাধিকারী আমার বাবার ওই শেয়ারের মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী মালিক। আমার বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকা অবস্থায় কুমিল্লায় মৃত্যুবরণ করেন। মারা যাওয়ার প্রায় এক বছর আগে থেকেই তিনি কুমিল্লাতে অবস্থান করছিলেন।
আমার বাবার ২৩ হাজার ৬০০ শেয়ার থেকে এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) আমাকে এবং আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে বঞ্চিত করার জন্য অবৈধভাবে নিজের নামে বেশি শেয়ার ট্রান্সফার করে হস্তগত করার হীন অসৎ উদ্দেশ্যে এক নম্বর আসামি ২ থেকে ৫ নম্বর আসামিদের (ট্রান্সকম কর্মকর্তা) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তিনটি ফর্মসহ ১১৭ (হস্তান্তর দলিল) আরো গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার ট্রান্সফারের বিভিন্ন কাগজপত্র আমার এবং আমার ভাইয়ের অজ্ঞাতসারে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে তৈরি করেন।
আমার বাবার মৃত্যুর পর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজপত্র ৩ নম্বর আসামি (কামরুল হাসান) রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে জমা দেন। এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) থেকে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে ৪ ও ৫ নম্বর আসামি (মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ও আবু ইউসুফ মো. সিদ্দিক) জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজে সাক্ষী হিসেবে সই করেন।’