কৃষি ও পরিবেশ

টাঙ্গাইলের চরাঞ্চল বিষাক্ত তামাক চাষে সয়লাব

আব্দুস সাত্তার, বিশেষ প্রতিনিধি: টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলে বেশি লাভের আশায় তামাক চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরা। চাষের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা দীর্ঘ মেয়াদে চরম স্বাস্থ্য ঝুকি নিয়ে তামাক চাষ করে যাচ্ছে। চরাঞ্চল বিষাক্ত তামাক চাষে সয়লাব হয়ে গেছে। যার ফলে ফসলি জমির উর্বরতা হারাচ্ছে। এছাড়া ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের নানা প্রলোভনে তামাক চাষে প্রান্তিক কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।

জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ১২ উপজেলার মধ্যে কালিহাতী, গোপালপুর, নাগরপুর, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল সদর এবং দেলদুয়ার উপজেলায় বেশি তামাক চাষ হচ্ছে। টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে জেলায় তামাক চাষের কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও চরাঞ্চলের নদী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় তামাক চাষ হচ্ছে।

কালিহাতী উপজেলার চরাঞ্চল দূর্গাপুর ইউনিয়নের চরহামজানী গ্রামে দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষকই তামাক চাষ করেন। বাড়িতে বাড়িতে চলছে তামাক পাতা শুকানোর কাজ। রোদযুক্ত স্থানে বাঁশের মাচায় তামাক পাতা শুকানো হচ্ছে। নারী-পুরুষ ও শিশু সবাই তামাক চাষ এবং শুকানোর কাজে ব্যস্ত। তাদের মুখে মাস্ক নেই- শরীরে নেই পোষাক। পুরো গ্রামের বাতাসে তামাকের তীব্র গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ চিত্র তামাক চাষ হওয়া প্রত্যেক এলাকার।

Image

তামাক চাষী ফরিদুল ইসলাম, রায়হান আলী, হারেছ মিয়া, শুকুর মামুদ সহ অনেকেই জানান, কোম্পানী (তামাক ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান) থেকে তাদের বীজ, সার, বিষ, ত্রিপল ও কাগজসহ উৎপাদনের যাবতীয় সামগ্রী দিয়ে থাকে। আবার তারাই তামাক পাতা কিনে নেয়। তারা শুধু চাষ করে তামাক পাতা রোদে শুকিয়ে সরবরাহ করে থাকেন। টাঙ্গাইল জেলায় মূলত ব্রিটিশ-অ্যামেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী ও আকিজ টোব্যাকো কোম্পানী তামাক চাষে কৃষকদের সহযোগিতা দিয়ে থাকে।

তামাক চাষী সুরুজ মিয়া জানান, তিনি দীর্ঘ ৬ বছর ধরে তামাক চাষ করছেন। তামাক চাষে অন্য ফসলের তুলনায় দ্বিগুন লাভ হয়। শরীরের ক্ষতি ও পরিবেশেরও ক্ষতি হয়। কিন্তু লাভও তো অনেক বেশি হয়। তাই তামাক চাষ করেন। প্রতি কেজি তামাক প্রকারভেদে ১৩০-১৫০ টাকায় কোম্পানী কিনে নেয়। পাতার আকার ও সংরক্ষণের প্রকারভেদে কোম্পানী দাম কম-বেশি নির্ধারণ করে। কোম্পানীর লোক ছাড়া বাইরের কেউ তামাক কিনে না- বিক্রি করারও সুযোগ নেই।

টাঙ্গাইলের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী সোমনাথ লাহিড়ী জানান, ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান দাদন দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করে। গ্রামের অসহায় কৃষক না বুঝে তাদের জমি ও জীবনের চরম ক্ষতি করছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে গণসচেতনতা এবং তামাকজাত পণ্যের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা দরকার। যাতে আসক্তরা সহসাই কিনতে না পারে।

Image

এ বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেণ্ট বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, তামাক চাষের প্রক্রিয়া থেকে সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন এবং ব্যবহার পুরোটাই পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তামাক চাষে বিভিন্ন প্রকার রায়াসনিক ব্যবহার করা হয়। যা পানি ও বায়ুকে ভীষণভাবে দূষিত করছে। মাটি উর্বরতা হারাচ্ছে। বেশি লাভে তামাক চাষ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘদিন তামাক চাষে যুক্ত থাকলে ক্যান্সার, পেটের পীড়া, ব্রঙ্কাইটিস, অ্যাজমা, চর্ম, বুক ও ঘাড়ে ব্যাথাসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এছাড়া তামাক চাষীদের সন্তনদের ‘গ্রীণ টোবাকো সিন্ড্রম’ নামে এক জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা বেড়ে যায়।

টাঙ্গাইল জেলায় তামাক চাষে লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ-অ্যামেরিকান টোব্যাকো কোম্পানী ও আকিজ টোব্যাকো কোম্পানীর স্থানীয় প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তবে তারা কোম্পানীর দেওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে থাকেন বলে জানান।

টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাশার জানান, তামাক চাষের বিষয়ে সরকারিভাবে তাদের কোনো নির্দেশনা নেই। তাই এ ক্ষেত্রে তারা কোন মতামত ও তামাক চাষে হস্তক্ষেপ করেন না। তবে তামাক চাষ রোধে গণসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারেরও ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker