জাতীয়

অশুর শক্তি বিনাশের প্রার্থনায় দুর্গতিনাশিনীর বিদায়

মর্ত্যে ‘বাবার বাড়ি’ বেড়ানো শেষে নৌকায় চড়ে ‘কৈলাসে দেবালয়ে’ ফিরেছেন ‘আনন্দময়ী’ দেবী দুর্গা। সিঁদুর খেলা, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও নানা আয়োজনে ঢাকের বাদ্য ছাড়া দুর্গতিনাশিনীকে বিদায় জানায় ভক্তকূল। দেবীর বিদায় বেলায় অশুভ শক্তি বিনাশের প্রার্থনা ভক্তদের। 

আজ মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে সকাল ৯টা ৫৮মিনিটে ‘বিহিত পূজা’ ও পরে ‘দর্পণ বিসর্জনের’ মধ্য দিয়ে দুর্গা পূজার শাস্ত্রীয় সমাপ্তি ঘটেছে।

দশমী পূজায় প্রতিমার হাতে জরা, পান, শাপলা ডালা দিয়ে আরাধনা করা হয়। পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন ভক্তরা। 

এদিন বিকেল ৪টায় বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নান ঘাটে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ঢাকের বাদ্য আর গান-বাজনা ছাড়া বিদায়ের করুণ ছায়ায় সারিবদ্ধভাবে একে একে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমা।

একই সময়ে তুরাগ নদীতে চলে বিসর্জন। এ উপলক্ষে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ পাড়ে ভক্ত দর্শনার্থীদের ঢল নামতে দেখা যায়।

অধিকাংশ মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমাটি রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু পূজার কাজে ব্যবহৃত দেবীর ফুল, বেলপাতা ও ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়।

রাজধানীর প্রায় অর্ধশত মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় ওয়াইজঘাটে। সন্ধ্যার আগেই অধিকাংশ এলাকায় বিসর্জন শেষ হয়। প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সবধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সড়কে পুলিশের টহল ও নদীতে ছিল নৌপুলিশের উপস্থিতি। ফায়ার সার্ভিসের টিমও দায়িত্ব পালন করে।

প্রথা অনুযায়ী, প্রতিমা বিসর্জনের পর সেখান থেকে জল এনে (শান্তিজল) মঙ্গলঘটে নিয়ে তা আবার হৃদয়ে ধারণ করা হয়। আগামী বছর আবার এ শান্তিজল হৃদয় থেকে ঘটে, ঘট থেকে প্রতিমায় রেখে পূজা করা হবে। রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ধ্যা আরতির পর মিশনের পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর ভক্তরা শান্তিজল গ্রহণ করেন ও মিষ্টিমুখ করেন।

Image

সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন মণ্ডপ ঘুরে দেখা যায়, পূজামণ্ডপে বিবাহিত নারীদের সিঁদুর খেলা। দেবীর চরণ থেকে সিঁদুর নিয়ে তারা একে অপরের মাথায় দেন। কেউ কেউ শেষবারের মতো দেবী দুর্গার সিঁথিতে লাগিয়ে দেন সিঁদুর। সারা দেশেই মায়ের প্রতিমা বিসর্জনের শেষ মুহূর্তের আরতি হিসেবে এই সিঁদুর খেলা হয়। স্বামীর মঙ্গল কামনায় দশমীর দিন নারীরা মা দুর্গার সিঁথিতে দেওয়া সিঁদুর নিজের সিঁথিতে লাগিয়ে আশীর্বাদ নেন। সিঁদুর, পান ও মিষ্টি নিয়ে দুর্গা মাকে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর একে অপরকে সিঁদুর লাগিয়ে দেন তারা। সিঁদুর খেলার পর শেষবারের মতো দেবীর আরাধনা করেন।

বিকেলে প্রতিমা বিসর্জনের উদ্দেশ্যে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গন থেকে কেন্দ্রীয় বিজয়া শোভাযাত্রা বের হয়। ভক্তরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ট্রাকে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হন ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির প্রাঙ্গণে। পরে ট্রাকে উঠানো প্রতিমা নিয়ে সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়।

স্বল্পগতির ট্রাকে চড়া প্রতিমাগুলো নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে শেভাযাত্রাটি শহীদ মিনার, হাইকোর্ট, পুলিশ হেড কোয়ার্টার, গোলাপ শাহ মাজার, কোর্ট এলাকা হয়ে সদরঘাট পৌঁছে। রাস্তায়, বিভিন্ন ভবনে পুলিশ ছিল সতর্কাবস্থায়। রাস্তার পাশে দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে মেলা ও সন্ধ্যায় সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যারূপে’ মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব। মহালয়ার দিনে ঘোড়ায় চড়ে দেবী মর্ত্যে আসেন। এরপর নবরাত্রির ষষ্ঠ দিন শুক্রবার মহাষষ্টী পূজার মধ্য দিয়ে দূর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সেই উৎসবের সমাপ্তি হল।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ জানিয়েছে, সারাদেশে এবছর ৩২ হাজার ৪০৮টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ২৪২টি। গত ৫দিনে মন্দিরে মন্দিরে বেজে ওঠা ঢাক-ঢোল, কাঁসর, ঘণ্টা আর শঙ্খধ্বনিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে আবহমান বাংলার প্রতিটি বাঙালিজন। উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে নৈসর্গিক নির্জনতা। মন্দিরে মন্দিরে মন্ত্র উচ্চারণ আর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বিশ্বের অশুভকে তাড়িয়ে শুভকামনা করা হয়। এসব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে লাগানো হয় সিসি ক্যামেরা। এছাড়া মণ্ডপ পাহারার জন্য স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয়।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker