নরসিংদী

‘ইচ্ছেমতো পোশাক’ পরে নরসিংদী রেল স্টেশনে ‘অহিংস অগ্নিযাত্রা’

নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে তরুণী হেনস্তার ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে ‘অহিংস অগ্নিযাত্রা’ শিরোনামে ‘যে যার খুশিমতো পোশাক’ পরে হাজির হন ২০ তরুণ-তরুণীর একটি দল। আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কিশোরগঞ্জগামী আন্তনগর এগারোসিন্দুর ট্রেন থেকে তাঁরা নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে নামেন। দলটির অন্তত ১৫ জন তরুণীর পরনে ছিল জিন্স ও টি-শার্ট।

তাঁদের ভাষ্য, গত ১৮ মে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে একজন তরুণী পোশাকের কারণে কুৎসিত আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হন।

আমরা তাঁর পাশে দাঁড়াতে চেয়েছি, তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আমরা ২০ জন তরুণ-তরুণী এ স্টেশনে আসলাম। আমরা এটাকে প্রতিবাদ হিসেবে দেখছি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিবাদে অংশ নেওয়া ১৭ জন তরুণী ও তিনজন তরুণ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। অংশগ্রহণকারীরা অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের নারীবাদী গ্রাসরুটস অরগানাইজিং প্ল্যাটফর্ম ‘মেয়ে নেটওয়ার্ক’ এ যুক্ত। একটি স্টোরিটেলিং প্রকল্প হিসেবে তাঁরা পিতৃতন্ত্রে নারীর আগুনে মোড়ানো পথের গল্পগুলো তুলে আনেন। ঢাকা-নরসিংদী যাত্রা এরই একটা অংশ। এই প্রতিবাদ কর্মসূচির সংগঠক ছিলেন অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারান।

প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া তরুণ-তরুণীদের নাম জানতে চাইলে তাঁরা এই প্রতিবেদককে তাঁদের সংক্ষিপ্ত নাম জানান। তাঁরা হলেন, তৃষিয়া, সুরভী, এ্যানি, আনোয়ার, অর্ণব, নুভা, মম, অপরাজিতা, সামিহা, সানজানা, স্মিতা, লক্ষ্মী, অন্তরা, মিশু, প্রমি, জিসা, নিশা, বিজু, ইফফাত, নীল। তারা একেকজন নারীবাদী, শিল্পী, সংগঠক, নাট্যকর্মী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, আলোকচিত্রী, গবেষক, উন্নয়নকর্মী ও প্রকৌশলী।

নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ২ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন থেকে নামার পরপরই তাঁরা নানা বয়সী অপেক্ষমাণ যাত্রী ও ভ্রাম্যমাণ দোকানিদের সঙ্গে ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে কথা বলেন। পরে তারা কয়েকটি উপদলে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্টেশনটির নানা প্রান্তে ঘোরেন। পরে স্টেশন মাস্টার এ টি এম মুছার সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন দলটির সদস্যরা। এর আগে রেলওয়ে পুলিশ ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গেও ওই দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলেন তাঁরা।

দলটির দলনেতা অগ্নি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সভাপতি তৃষিয়া নাশতারান জানান, আজ আমরা নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন ও এখানকার মানুষদের দেখতে এসেছি। তাঁদের সঙ্গে আমরা মানবিক যোগাযোগ স্থাপন করতে চেয়েছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিপূর্ণভাবে জনপরিসরে শরীর ও পোশাকের স্বাধীনতার জায়গা রিক্লেইম করা। আমাদের বৈচিত্র্যময় শারীরিক উপস্থিতিই আমাদের বক্তব্য। তৃষিয়া নাশতারান আরো জানান, জায়গাটা দেখলাম, মানুষগুলোকে শুনলাম। আজ রাত ১১টায় মেয়ে নেটওয়ার্কের ফেসবুক পেজে আমরা লাইভে এসে আলোচনা করব আজকের অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণ নিয়ে।

জানতে চাইলে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার এ টি এম মুছা জানান, দলটি ঢাকা থেকে ট্রেনে করে আমাদের স্টেশনে এসে নেমেছেন। তাঁরা স্টেশন ঘুরে দেখেছেন এবং এখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার সঙ্গে তাঁরা বসেছিলেন, জানতে চেয়েছেন ওই দিনের বিস্তারিত। আমিও তাঁদের ওই ঘটনার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানিয়েছি। তাঁরা তরুণী হেনস্তার প্রতিবাদ জানাতে এসেছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন।

এর আগে গত ১৮ মে, বুধবার ভোর সোয়া ৫টার দিকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে আসেন এক তরুণী ও দুই তরুণ। সকাল পৌনে ৬টা পর্যন্ত স্টেশনটির ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে তাঁরা ঢাকাগামী ঢাকা মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় স্টেশনে মধ্যবয়সী এক নারী ওই তরুণীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটা কী পোশাক পরেছ তুমি’। তরুণীও পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আপনার তাতে কী সমস্যা হচ্ছে?’ এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। এর মধ্যে সেই বিতর্কে যোগ দেন স্টেশনে অবস্থানরত অন্য কয়েকজন ব্যক্তি।

ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, ওই তরুণীকে ঘিরে রেখেছে একদল ব্যক্তি। এর মধ্যেই এক নারী উত্তেজিত অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। বয়স্ক এক ব্যক্তিও তাঁর পোশাক নিয়ে কথা বলছেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী সেখান থেকে চলে যেতে চাইলে ওই নারী দৌড়ে তাঁকে ধরে ফেলেন। এ সময় অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে তাঁর পোশাক ধরে টান দেন ওই নারী। কোনোরকমে নিজেকে সামলে দৌড়ে স্টেশনমাস্টারের কক্ষে চলে যান তরুণী।

রেলওয়ে পুলিশ বলছে, সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ২১ মে শুক্রবার রাত ৯টার দিকে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন এলাকা থেকে ঘটনায় জড়িত মো. ইসমাইলকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাঁকে ভৈরব রেলওয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরদিন শনিবার বিকেলে তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ সিদ্দিকীর আদালতে তোলা হয়। আদালত তাঁকে জেলহাজতে পাঠান এবং এই ঘটনায় মামলা করার নির্দেশ দেন।

ওই রাতেই ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করেন নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমায়েদুল জাহেদী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলাটি করা হয়। মামলায় মো. ইসমাইল ও শিলা আক্তারের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরো একজন নারী ও ৮ থেকে ১০ জন পুরুষকে আসামি করা হয়। গত সোমবার ইসমাইলকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। তবে তরুণীকে গালিগালাজ, মারধর, শ্লীলতাহানি ও মুঠোফোনে ছবি তোলার অভিযোগে অভিযুক্ত এবং মামলার আসামী ওই নারীকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সম্পর্কিত সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker