সুরের আকাশে আজ কালোমেঘ। চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে হতেই ফের নক্ষত্রপতন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। বাংলার সঙ্গীতজগতে মাতৃবিয়োগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন আরেক বঙ্গসন্তান বাপ্পি লাহিড়ী। ডিস্কো মিউজিকে তিনি কাঁপন ধরিয়েছেন বলিউডের মঞ্চে।
এই জোড়া শোক মেনে নিতে পারছে না সংগীতদুনিয়া। শোকের ছায়া সংগীত মহলে। মৃত্যুকালে বাপ্পি লাহিড়ীর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। গত বছরই এপ্রিল মাসে তিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর করোনামুক্ত হলেও, নানা শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন তিনি।
১৯৭০-৮০ এর দশকে গোটা বলিউড মেতে উঠেছিল বাপ্পি লাহিড়ীর গানেই। ডিস্কো ডান্সার থেকে শুরু করে শরাবি, চলতে চলতের মতো বিভিন্ন জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন তিনি। ২০২০ সালে বাগি ৩ সিনেমায় তিনি শেষ গান করেছিলেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ একমাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সোমবারই তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। কিন্তু মঙ্গলবারই ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। এরপর ফের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মধ্যরাতের কিছু সময় আগে তার মৃত্যুর হয়। অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়াকেই তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে জানানো হয়েছে। এটি নিদ্রা সংক্রান্ত অসুখ।
সংগীতের ‘ডিস্কো বয়’
মাত্র ১৯ বছর বয়সে সংগীত জগতে প্রবেশ করেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। বলিউডের ‘ডিস্কো বয়’ নামেই পরিচিত বাপ্পি লাহিড়ি। হাসিমুখ, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার স্বভাবের কারণে সংগীত দুনিয়া থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। বাংলা সিনেমায় গান গাওয়ার পাশাপাশি হিন্দিসহ একাধিক ভাষাতেও গান করেছেন তিনি।
১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার মা-বাবা বাঁসুরি লাহিড়ী ও অপরেশ লাহিড়ীও সংগীতের মানুষ। বিখ্যাত গায়ক কিশোর কুমারও তার আত্মীয়। ছোট থেকেই শাস্ত্রীয় সংগীত ও শ্যামা সংগীতের পরিবেশে বড় হয়েছেন। মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই তবলা বাজানো শেখা শুরু করেন বাপ্পি লাহিড়ী। ১৯ বছর বয়সে তিনি মুম্বাই পাড়ি দেন। ১৯৭৩ সালে তিনি প্রথম সংগীত নির্দেশনা করেন। এরপরে আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।
ডিস্কো ডান্সার গান হিট হওয়ার পরই জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান বাপ্পি লাহিড়ী। মিঠুনের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি একের পর এক বিখ্যাত গান গেয়েছেন। তবে ডিস্কো গানই নয়, চলতে চলতে বা জখমীর মতো মনোমুগ্ধকর গানও গেয়েছিলেন তিনি। প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংগীত জগতের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
শুধু গানই নয়, নিজস্ব স্টাইলের জন্যও পরিচিত ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। সোনার গয়না পরতে তিনি খুব ভালবাসতেন। তার বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘সোনাই আমার ভগবান।’
স্মরণে বাপ্পি লাহিড়ী
“হে ভগবান! কী করে হল বুঝতে পারি না। ‘রাম্মা হো’, ‘কোই ইহা নাচে নাচে..’, ওর সুরে গাওয়া কত গান আমার হিট হয়েছে। আমার আর বাপ্পিদার জুটিটা ভেঙে গেল..” বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন উষা উত্থুপ।
স্মৃতিচারণা করে আরতী মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘তখন তোমার একুশ বছর গানটা গাই ওর (বাপ্পি লাহিড়ীর) সুরে। শিক্ষা, মনোকামনা, প্রতিমা- বাপ্পির সুরে বহু হিন্দি ছবিতে গেয়েছি। খুব ভাল সুর করতেন। ওই সময়ে এরকম একটা হিট গান কম শুনেছি। ঈশ্বরের পরম আশীর্বাদ ছিল বাপ্পির ওপর। সুন্দর ব্যবহার ছিল। কখনও উঁচু গলায় কথা বলেননি।’
জনপ্রিয় তবলাশিল্পী বিক্রম ঘোষ বললেন, ‘আমি ভাবতে পারছি না। কাল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আর আজ বাপ্পি লাহিড়ী। বাপ্পিদার তো বয়সও হয়নি সেভাবে। খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। উনি অনেক কিছু শিখিয়েছেন।’
শিল্পী জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘ভারতবর্ষের সংগীতের মহান তারকাকে চলে যেতে হল। যে মানুষটার মনেপ্রাণে বাঙালি। দেশের খ্যাতনামা ডিস্কো সং-কে কত ভালভাবে প্রেজেন্ট করেছেন। কিন্তু বাঙালিয়ানা কখনও ভুলে যাননি। আমাকে খুব স্নেহ করতেন। বলতেন, জিৎ গানের অন্তরা, ওটার মুখরাটা খুব ভাল হয়েছে, কী করে বানালি। কালকে সন্ধ্যাদি, আর আজ বাপ্পিদা, পিতৃস্থানীয় মানুষ। সঙ্গীত জগতের অনেক বড় ক্ষতি হল। আমি বাপ্পিদাকে কভি আলবিদা না কহেনা… (কখনও বিদায় বলবো না)’।