সাহিত্য

কয়েক প্রজন্মের ছোটবেলা তুলি-কলমে বেঁধে রেখেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ

অবিভক্ত ভারতের বুকে ১৯২৫ সালে নারায়ণ দেবনাথের জন্ম। হাওড়ার শিবপুর প্রাচীন শহর। বলতে গেলে বাণিজ্যনগরীর প্রাণকেন্দ্রই শিবপুর। নারায়ন দেবনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শিবপুরে। বাড়ির ঠিকানা ৫২/২ শিবপুর রোড। পারিবারিক আদি বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে হলেও তার জন্মের আগেই শিবপুরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে দিয়েছিল তার পরিবার।

বাবা হেমচন্দ্র দেবনাথ আর মা রমলা দেবী। তিন ভাইবোনের বড় নারায়ণ। তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। গঙ্গার ধারের এক নিতান্ত গঞ্জগ্রাম শিবপুর। সেখানকার এক পাঠশালায় গুরু বেণীবাবুর অধীনে বালক নারায়ণের প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু। তারপর ভর্তি হলেন বি কে পালস ইন্সটিটিউশনে।

ছোট থেকেই আঁকার দিকে ঝোঁক। ভালো কোনও ছবি বা প্রতিকৃতি দেখলেই এঁকে ফেলার চেষ্টা করতেন কিশোর নারায়ণ। আত্মীয়স্বজন শুভানুধ্যায়ীরা আর্টস্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আর্টস্কুল কোথায় সে ধারণাটুকুও তখন ছিল না মধ্যবিত্ত বাবা হেমচন্দ্র দেবনাথের। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রতিবেশী নিলুদা। তার চেষ্টাতেই একটা প্রাইভেট আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেন নায়ায়ণ দেবনাথ। এরপর স্কুলের শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ভর্তি হলেন ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের পেইন্টিং বিভাগে।

সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কাল। এই যুদ্ধের ডামাডোলে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি নারায়ণ দেবনাথ। এদিকে সংসারে টাকা দরকার। তাই আঁকিবুঁকির পসরা নিয়ে ভাগ্যের খোঁজে তরুণ নারায়ণ নেমে পড়েন ইন্ডাস্ট্রিতে। এর কিছু আগেই নারায়ণ দেবনাথের বাবা ও কাকার যৌথ প্রচেষ্টায় পারিবারিক সোনার দোকান কমল শিল্পালয় গড়ে ওঠে। সোনার পাতের উপর ড্রয়িং করে সোনার গয়নায় নকশা তুলতেন কাকা। তার দেখাদেখি কিশোর নারায়ণও শুরু করলেন সোনায় নকশা তোলা। এভাবেই কিশোরমনে আঁকাআঁকির ঝোঁক মেটাতেন তিনি। যদিও বড়ছেলে নারায়ণ পারিবারিক ব্যবসাতে নামুক এটা একেবারেই চাননি বাবা কাকা।

সেসময় আর্টিস্টদের কাজের সুযোগ ছিল না তেমন। টিভি বা মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তও নেই। অগত্যা কসমেটিকস কোম্পানির লেভেল তৈরি করতেন নারায়ণ দেবনাথ। আঁকতেন সিঁদুর আলতার বিজ্ঞাপন। সচল বিজ্ঞাপনের বদলে তখন সিনেমাহলে চলত সিনেমা স্লাইড নামের একরকম বিজ্ঞাপন। সেই স্লাইড তৈরিতেও দক্ষতা অর্জন করেন তিনি।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রতিবেশী-কন্যা তারাদেবীর সঙ্গে বাঁধা পড়লেন বৈবাহিক বন্ধনে। গান্ধীহত্যার পর নিষ্প্রদীপ কলকাতায় সে এক অন্যরকম বিয়ে। এক মেয়ে আর দুই ছেলের জন্ম তারপর।

দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার সুবোধ চন্দ্র মজুমদারের ভালো লেগে গেছিল নারায়ণ দেবনাথের কাজ। তার ডাকেই দেব সাহিত্য কুটিরে পা রাখা। শুকতারায় ইলাস্টেশনের কাজ শুরু করলেন নারায়ণ দেবনাথ। এরপরই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিদেশি পত্রপত্রিকায় অনুকরণে ছবি দিয়ে গল্প লেখার প্রস্তাব এল তাঁর কাছে। খুদে পাঠকদের কথা মাথায় রেখে শুরু হল হাঁদাভোঁদা সিরিজ। তারপর বাকিটা তো ইতিহাস। একে একে সৃষ্টি হল বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টের মতো কালজয়ী কমিক্স চরিত্র।

১৯৬৫ র ভাদ্রমাসে বাঁটুল দি গ্রেটের জন্ম। দেশে তখন ভারত-পাক যুদ্ধের ডামাডোল ঘনিয়ে এসেছে। এরপর দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশে কিশোরভারতী পত্রিকার পুজো সংখ্যায় জন্ম নিল নন্টে ফন্টে, আর তাদের রাইভ্যাল বিচ্ছু কেল্টুদা। সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং প্রেমেন্দ্র মিত্র। নন্টে ফন্টের আগে কিশোরভারতীতে তার আঁকা প্রথম ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ ‘ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ’, একটিমাত্র সংখ্যা বেরিয়েছিল তার। রঙিন আর সাদাকালো, একের পর এক কমিক্স স্ট্রিপের মধ্যে দিয়ে জয়যাত্রা শুরু হল নারায়ণ দেবনাথের।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার লেখা ও আঁকা কমিকস ছোট-বড় বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। কমিক-স্ট্রিপ ছাড়াও তিনি শিশু-কিশোরদের উপন্যাস অলঙ্করণ করেছেন। শুকতারা, কিশোর ভারতী প্রভৃতি কলকাতা ভিত্তিক শিশু-কিশোরদের পত্রিকায় সেসময় তার আঁকা কমিকসের পথ চেয়ে বসে থাকত কচিকাঁচার দল। এমনকি বড়রাও। পরিণত মানুষের বুকের ভিতরে যে শিশুসত্তা ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তাকে সর্বসমক্ষে টেনে বের করে আনার দক্ষতা ছিল নারায়ণ দেবনাথের।

২০১১ সালে লালমাটি প্রকাশন তার বিরল কাজগুলি পুনরায় প্রকাশ করে নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র ১ম ও ২য় খন্ড হিসেবে। ২০১২ সাল নাগাদ সর্বভারতীয় পাঠকদের কথা মাথায় রেখে প্রথমবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় বাঁটুল দি গ্রেট। যে পরিমাণ কাজ করেছেন সারাজীবনে, সে তুলনায় স্বীকৃতি পেয়েছেন নগণ্য। পুরস্কারের তোয়াক্কা না করে নিরলস কাজ করে গেছেন আজীবন। মৃত্যুর আগে ২০২২ এ ভারত সরকার কর্তৃক পেলেন সারাজীবনের স্বীকৃতি, পদ্মশ্রী সম্মান। তার মৃত্যুতে বাংলা কমিকস্ এক স্বর্ণ যুগের অবসান হল।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker