ইতিহাস ও ঐতিহ্যকিশোরগঞ্জ

হঠাৎ শীতের হাতছানি গ্রামে গঞ্জে কুয়াশার শুভ্র চাদর

হঠাৎ যেন শীতের আগমনী বার্তা জানান দিল কিশোরগঞ্জের হোসেন পুরের গ্রাম গুলিতে প্রকৃতির রুক্ষতা, কুয়াসার শুভ্র আবরণে ঢাকা সকাল ও সন্ধার পরিবেশ, ত্বকে মনে আমূল-পরিবর্তন। এ যেন শীতের আবির্ভাবের কথায় বলছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ষড়ঋতু বাংলায় বয়ে আনে রকমারী রূপ। ঋতু আসে, ঋতু যায় প্রকৃতি সাজে নানারঙে নানা সাজে। এমনই এক ধারাবাহিকতায় হেমন্তের পর আসে শীত। শীত বাংলাদেশে আসে রিক্ততার রূপ ধারণ করে। বন-বনানীর পাতা ঝড়ার বার্তা বয়ে আনে শীতকাল।

পৌষ ও মাঘ এ দু মাস শীতকাল । এ ঋতু অনেকেরই প্রিয় ঋতু। এ ঋতুর তুলনা হয় না। শীতকালে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। ফলে পথঘাটে স্বাচ্ছন্দে হাঁটা-চলার আনন্দ পাওয়া যায়। শীতকালে প্রচুর পরিমাণে শাকসব্জি পাওয়া যায়। এছাড়া শীতকালে এদেশের মানুষ পিঠাপুলি খেতে ভালােবাসে। শীতের সকালে খেজুর রসের কথা মনে হলে কার না ইচ্ছে করে শীতকালে ফিরে যেতে কবি সুফিয়া কামাল তাই শীতকে স্মরণ করেছেন এভাবে-

"পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে
আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।
কুলের কাঁটার আঘাত সহিয়া, কাঁচা-পাকা কুল খেয়ে,
অমৃতের স্বাদ যেন লভিয়াছি গাঁয়ের দুলালী মেয়ে।"

শীতের সকাল যেকোনাে সকালের চেয়ে ব্যতিক্রম। গাছের পত্রপল্লবের কোনাে ফাঁক দিয়ে সকালের সােনা রােদ এসে স্পর্শ করে আমাদের বারান্দা আর উঠোন। শীতের সকালে ঈষদুষ্ণ রােদে বসে শীতের পিঠাপুলিতে সকালের নাশতা করতে সবারই ইচ্ছে হয়। গায়ে চাদর জড়িয়ে মেঠো পথে হাঁটতে গেলেই শিশির ভেজা ঘাস পায়ের গােড়ালি ভিজিয়ে দেয়। শিমুল ফুলের লাল পাপড়ির আড়ালে বসে দোয়েল, কোয়েল, ময়না, টিয়ে কিচিরমিচির শব্দ তুলে নেচে ওঠে কলতানে। সূর্যোদয়ের সময় পাখিরা গান গেয়ে গেয়ে শীতের সকালকে স্বাগত জানায়। সমস্ত আয়ােজনটা তখন হয়ে ওঠে প্রাকৃতিক। সামনে চোখ বাড়ালেই ফসলহীন শূন্য মাঠ, পাতাঝরা শূন্য গাছ দেখে তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন অভিমান করে ছুড়ে ফেলেছে তার পুরাতন সাজ। কবি কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—

“শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে। পাতাগুলি শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।”

গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা আর সূর্যমুখীর গায়ে কাঁচা রােদের কোমল স্পর্শে যে ঝকঝকে সুন্দরের বিচ্ছুরণ ঘটে, তা সত্যিই শীতের সকাল ছাড়া অন্য কোনাে সময়ে অবলােকন অসম্ভব।

গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পেশাগত দিক থেকে কৃষির সাথে জড়িত। তাই শীতের সকালেও তাদের শীতের আরাম ও আনন্দকে উপভােগ করার সময় থাকে না শীতের কুয়াশা ভেদ করে লাঙল নিয়ে তারা ছুটে  ফসলের মাঠে। শীতকাল ইরি ধান রােপণের প্রধান সময়। এ সময়ে কৃষকের বসে থাকলে চলে না। অন্যদিকে, কৃষাণী বধূরাও সব্জি ক্ষেতে শুরু করে পরিচর্যা, আবার কেউ তােলে শাক-সব্জি। শীতের কনকনে ঠান্ডা বার্ধক্য, পীড়িতদের খানিকটা বেশিই চেপে ধরে। তাই ভাের হলেই খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়ে তারা উষ্ণ করে নেয় তাদের শরীর। এ সময় শিশুরাও এসে যােগ দেয়। আগুন পােহানাের কাজে। আর মাঝে মধ্যে চলতে থাকে রসপূর্ণ গল্পকথা। ওদিকে পিঠা বানানাের ধুম পড়ে যায় রান্নাঘরে। গরম গরম পিঠা আর মিঠে রােদ সব মিলিয়ে যেন অভূতপূর্ব আনন্দের। দরিদ্র এ দেশে শীত হতদরিদ্র মানুষের জন্যে নিয়ে আসে দুর্ভোগ। নগরে ভাসমান মানুষ হয় শীতের নির্মম শিকার। বাস্তুহীন শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ফুটপাতে, রেলস্টেশনে গরম কাপড় ছাড়াই প্রচণ্ড শীতের সাথে লড়াই করে।

বাংলাদেশের শীতকাল আনন্দ ও অবকাশের এক বিশেষ ঋতু। শীত বয়ে আনে ডালিয়া, গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকার ঘ্রাণ। কুয়াশাঘেরা প্রকৃতি তুলে ধরে শিশিরের সৌন্দর্য। রসনা বিলাসী বাঙালি শীতেই লাভ করে পিঠাপুলির তৃপ্তি। কিন্তু ঋতুগত ভাবে শীতের আবির্ভাব না হতেই প্রকৃতিতে নেমে পড়েছে শীতের আমেজ। বিশেষ করে গোধূলী নামার সাথে সাথে শীতের অনুভূতি ছুঁতে আরম্ভ করে শরীর, কুয়াসার শুভ্র চাদরে ঢাকতে থাকে গ্রামের প্রকৃতি, হোসেনপুরের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা মিলে শীতে ভেজা শীতল অনুভূতির। 

আবহাওয়া  অধিদপ্তরের সূত্র মতে জানা যায়, শীত এবার আগে ভাগেই নামবে। আবহাওয়ার অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে এবার আগে ভাগেই শীত নামবে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রয়ারি পর্যন্ত শীতকাল হিসেবে ধরা হলেও এই বছর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আস্তে আস্তে দিন এবং রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া দপ্তরের কর্মকর্তারা। এটা উপলব্ধি হচ্ছে  হোসেনপুরে, সবাই গুছিয়ে রাখা লেপ,কম্বল,শীতের জামা নামাতে ব্যাস্ত।

বিশেষ সূত্রে জানা যায়, আবহাওয়াবিদ ড: আবুল কালাম মল্লিক বলেন ‘দেশের উত্তর-পশ্চিমে একটা উচ্চ চাপ বলয় বিরাজমান করছে এখন। এই উচ্চ চাপ বলয় বঙ্গপোসাগরের জলীয় বাষ্পকে দক্ষিণের দিকে ঠেলে দেবে। ফলে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের কাছাকাছি থাকবে। সেই তাপমাত্রাটা গড়ে ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠা-নামা করবে অঞ্চলভেদে। সেই হিসেবে নভেম্বরে এই তাপমাত্রা থাকবে। যেটা শীতকালে সাধারণত গড় তাপমাত্রা থাকে’।

তবে প্রথম শ্বৈত্যপ্রবাহটি ডিসেম্বর মাসের শুরুতেই হবে বলে জানাচ্ছেন, মল্লিক। এটি হবে একটি মৃদু শ্বৈত্যপ্রবাহ। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ একটি তীব্র শ্বৈত্যপ্রবাহ হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

মল্লিক বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে শ্বৈত্যপ্রবাহের সংখ্যা কমে গেছে। তীব্র এবং মাঝারি শ্বৈত্যপ্রবাহের সময় সীমাটাও কমে আসছে। তবে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ যেগুলো হচ্ছে, সেটি দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করেন, এই আবহাওয়াবিদ। এ সব শ্বৈত্যপ্রবাহ দশ দিন থেকে শুরু করে একুশ দিন পর্যন্ত থাকছে।

আবহাওয়ার অধিদফতর বলছে, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, নেত্রকোনা, যশোর, কুষ্টিয়া কখনো কখনো রাঙ্গামাটি অঞ্চলে এই মৃদু শৈত্যপ্রবাহ হবে এবার।

আবহাওয়া অধিদফতরের ক্যাটাগরিতে শৈত্যপ্রবাহ ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস-মৃদু শৈত্যপ্রবাহ/ ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস-মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ/ ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস-তীব্র শৈত্যপ্রবাহ/ ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নীচে-অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ।

শীতের কাছে আমি সেই ছোটবেলা থেকে নতজানু। বার বার শীতের কাছেই হেরে গিয়েছি বিভিন্ন ভাবে। সে আসছে, এই পূর্বাভাসেই আমি জবুথবু এক জরাগ্রস্ত মানুষ। 

ছোট্টবেলা থেকেই ভয় পায় শীতকে, হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছি  মামাবাড়িতে তাদের পুকুর থেকে ও আমার আপন গ্রামের বুক ছিরে বয়ে চলা ব্রম্মপুত্র নদের জলরাশীর  শৈত‍্য বাষ্পের ধোঁয়া ও কুয়াশার জলছবি। তার সঙ্গে ছিল বিরামবিহীন শেয়ালের আর্তনাদ।

তারপর এই ঠান্ডায় বিএনসিসি ক্লাসে যাওয়া ও আসা ছিল চরম এক অশান্তি । বেশ মনে আছে ক্লাস ইলেভেনে   থাকা অবস্থায় বিএনসিসি ক্লাস করতে  যেতাম কবির স্যারের কাছে। উনি সকাল  ছটা থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ করাতেন। ওই শীতের সকালে কুয়াশার বৈঠা টেনে সাহেবের চর গ্রাম থেকে হোসেনপুর কলেজ মাঠে  যাওয়া ছিল বেশ আতঙ্কের বিষয় । কিছুদিন যাবার পর স‍্যারকে জানিয়েই দিলাম আমার চরম সিদ্ধান্ত, আমি পারলাম না শীতকে জয় করতে। ক্ষণস্থায়ী এই ঋতুর কাছে আমি পরাজিত।’ অনেকটা ঠিক ওই হিংসুটি মানুষটার মতো। কাবাডি খেলায় আমাকেই বার বার জাপটে ধরে!

কর্মের সুকল‍্যাণে আমি বহুবার শীতের কাছে হাতজোড় করে করুনা ভিক্ষে চেয়েছি। শীতের খড়খড়ে গাল চিরে ফাটা ঠোঁট আমাকে লজ্জিত করেছে দিনের পর দিন। স্কুলে অথবা কোন গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ উপস্থিত হতেই হবে, তাও আবার শীতকাল! কথায় বলে না, একে তো মা মনসা..তার ওপর ধূপের গন্ধ!ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা তার উপর শীত কাল! ঘন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে চলেছি আমি। টিমটিম করে জ্বলছে বাস অথবা ট্রেনের হেডলাইট। প্রকান্ড আকাশে একটি তারা আর এক খন্ড চাঁদ আমাকে দেখে হেসেছে বহুবার। অথচ আমি! কখনও রেজাল্ট হাতে নিয়ে বসে আছি, চোখের সামনে কয়েক’’শ কিশলয়ের নিষ্পাপ অস্থির চাউনি।

যাঁদের মুখে শুনি শীত বেশ আরামদায়ক । আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি । আর মনে মনে ওই ব‍্যক্তিকে স‍্যালুট জানাই। তাঁরাই পেরেছেন এই শৈত‍্য দানবকে বশ করতে। 

আজ ৩ নভেম্বর( বুধবার),  মধ‍্য গগনে এসে ঝিমুনি নয়নে দেখি কুয়াশা বাহিনীর জমায়েত। আকস্মিক থমকে দাঁড়ালাম, আমাকে কাবু করতে শীতের বুজি আর দেরি সয়লোনা তাই সময়ের পূর্বেই চলে এলো।

অন্যমনে ভাবি এ আবার ঋতুর বিপর্যয় নয় তু?পৃথিবীতে সব কিছুরই যখন পরিবর্তন হয় ঋতু আবার বাদ থাকবে কেন?

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker