বিনোদন

বিরক্তি নিয়ে আমি লজ্জিত নই: সায়ান

স্পষ্ট কথার সচেতন নাগরিক ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। গান ও কবিতায় নিয়মিত মানুষের বন্দনা করেন, দেশ ও দশের কথা বলেন। পহেলা বৈশাখে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান’ নিয়ে তাঁর একটি মন্তব্য ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ নিয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছেন শিল্পী, প্রকাশ করেছেন একটি গানও। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কামরুল ইসলাম‘ স্বাধীনতার মুগ্ধতা’ গানটি প্রকাশ করলেন। এটা কবেকার গান? প্রেক্ষাপট জানতে চাই…

এটা প্রকাশিত গান, তবে খুব একটা প্রচারিত না আর কি। তা ছাড়া আমার গান আগে সেভাবে প্রচারিত ছিলও না, এখন হয়তো একটু বেশি মানুষ শুনছে। ২০০৬-এ লেখা, ২০০৭-এ সুর করা। তখন বিএনপি সরকার শেষের দিকে, ওই সময়ে লেখা গানটি।হায়দার ভাইয়ের [হায়দার হোসেন] একটা গান আছে, ‘তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি’; এটার অন্য এক রূপ আমার এই গান। স্বাধীনতা পাইনি, এটা তো ঠিক না। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের তো একটা পরিচয় দিয়ে গেছেন।

সুতরাং একদমই পাইনি বললে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অস্বীকার করা হয়।আবার গানবাজনাকে একদম আক্ষরিক অর্থেও দেখলে হয় না। হায়দার ভাইয়ের গানের মূল ব্যাপার হলো, স্বাধীনতা মানে শুধু ভূখণ্ডের স্বাধীনতা নয়। কপালে পট্টি বেঁধে, লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে কেবল উদযাপন করলাম আর ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’ গাইলাম, শহরজুড়ে ঘুরলাম; এখানেই শেষ? দেশ মানে সর্বস্তরের মানুষ এবং তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন।

যে মানুষটা পাকিস্তান আমলেও অভাবে ছিল, স্বাধীনতার পরও যদি সে ভালোভাবে খেতে না পারে; যদি তাকে ঋণের জন্য ট্রেনের নিচে পড়ে মরে যেতে হয়, তাহলে ওই মানুষটার জন্য স্বাধীনতা কী? তাকে বাদ দিয়ে তো বাংলাদেশ নয়। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটও এমন ছিল।তাই মনে হয়েছিল, স্বাধীনতার মুগ্ধতা আমাদের কখনো যাবে না।

অবশ্যই এটা আমাদের বিরাট অর্জন। কিন্তু অভাবি মানুষটার জীবনে যদি একটু সচ্ছলতা না আসে, তাহলে আমাদের উঁচু মাথা নিচু হয়ে যাবে। এই লজ্জাবোধ থাকা উচিত। আমাদের দেশে অনেক মানুষ অন্যায়ভাবে সুবিধাভুক্ত, এসব বৈষম্য দূর করতে হবে। আর কিছু না হোক, অন্তত খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।

সাধারণ মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, এটা মানা যায় না। এই গানে একটা কথা আছে, ‘আমরা চলো সাহস করে বর্তমানের হাত ধরি, মুখগুলো সব বন্ধ রেখে না হয় কিছু কাজ করি।’ অর্থাৎ কেবল উদযাপন আর বন্দনা নয়, কাজও করতে হবে।পহেলা বৈশাখ উদযাপনে গিয়ে জুলাই নিয়ে একটা মন্তব্য করেছেন। সেটা নিয়ে আবার কৈফিয়ত দিতে হলো!

দেখুন, বিরক্তি নিয়ে আমি লজ্জিত নই। তবে একটা জায়গায় অবশ্যই আমার ভুল—যে বাচ্চারা মারা গেল, যারা হাত-পা-চোখ হারাল, ওদের পরিবার কি সারাক্ষণ জুলাই জুলাই করে? না। বরং যারা জুলাই নিয়ে রাজনীতি করে, তারা এটা করে। আপনি যদি জুলাই সৈনিকদের দেখেন, বেশির ভাগকে চিনবেন না। কারণ তারা পরিচিত কেউ নয়, রকস্টার নয়, আমার মতো কোনো শিল্পী নয়। তারা সবাই সাধারণ মানুষ। মৃত্যুর কথা ভেবেই তারা রাস্তায় নেমেছিল।

সেই শহীদদের হত্যার বিচার এখনো হয়নি। আবরারের মা কিংবা ফাইয়াজের মা জুলাই জুলাই করেন না। কিন্তু তাঁদের তো আমি দুঃখ দিতে পারি না। আমার একটা শব্দের কারণে যদি ওই মায়েরা ব্যথা পান, আমি তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। যাঁদের বাচ্চা চলে গেল, তাঁদের কাছে জুলাই কখনো শেষ হবে না। সেই মানুষদের জন্য তো একটা অসংবেদনশীল কথা বলে ফেলেছি।

এ জন্য আমার অবশ্যই ক্ষমা চাওয়া উচিত। তাই কৈফিয়ত দিয়েছি। কিন্তু যারা আমাকে প্রতিদিন হুমকি, গালি দেয়, তাদের কৈফিয়ত দেইনি। ওই দিন আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। আমিও তো মানুষ। উৎসবের দিনও যদি শেখ হাসিনাকে গালি দিয়ে শেষ করি, তাহলে সেটা খুবই সামান্য বিষয় হবে। এমন সংস্কৃতি আগেও ছিল। বিরোধী দলের বিষোদগার করা হতো। ঘৃণার চর্চাকে যদি দেশপ্রেমের অংশ হিসেবে দাঁড় করাই, এটা খুব শর্টকাট।

তার চেয়ে একটা গাছ রোপণ করা ভালো, একজন কৃষকের পাশে দাঁড়ানো ভালো; জুলাইয়ে যে দুই হাজার মানুষ চলে গেল, তাদের পরিবারের অন্তত একটা মানুষের খোঁজ রাখা ভালো। শেখ হাসিনার বিচার অবশ্যই হতে হবে, তাঁর দোসরদের বিচার হতে হবে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা দিয়ে যারা তাঁর অন্ধ সমর্থনে ছিল, তাদেরও সামাজিকভাবে ধিক্কার জানানো উচিত।

কারণ তাদের বাড়তি দায়িত্ব আছে। আমি একজন শিল্পী, সারাক্ষণ কেবল সরকারের প্রশংসা করে গেলাম, তাহলে তো দেশের হয়ে কাজ করলাম না।কনসার্ট বন্ধ, মাজার ভাঙা কিংবা লালন মেলা বন্ধের মতো কিছু ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে। এসব বিবেচনা করে সংস্কৃতি অঙ্গনের সংস্কার নিয়ে কিছু বলবেন?মাঝে কিছু কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল, কী কারণে বন্ধ হয়ে গেল, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। কারোর চাপে? তাহলে এখনই সময় খুব শক্ত অবস্থান নেওয়ার।

যাঁরা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের মধ্যে আন্তরিকতা দেখতে পাই, আবার ব্যর্থতাও দেখতে পাই। আমি মনে করি, জনগণ হিসেবে সব সময় অসন্তুষ্ট থাকার অধিকার রাখি। আমি প্রশংসা না করলে আপনি দোষী করতে পারেন না। আমি যেহেতু জনগণ, দেশের মালিক; সে জায়গা থেকে তাঁদের প্রশংসা করব না। কিন্তু দোষ ধরব। সরকারের উদ্দেশে বলব, এসব ব্যাপারে বাড়তি সাবধান থাকা দরকার। পতিত স্বৈরাচারীদের হাতে যেহেতু অনেক টাকা, তারা নানাভাবে সমস্যা করছে।

তবে শত্রু সম্পর্কে জ্ঞান রাখাও সরকারের দায়িত্ব। আওয়ামী লীগের লোকজন ঝামেলা করছে বলে তো আপনাকে আমি মাফ করব না। জনগণের স্বার্থে আপনাকে পাহারা দ্বিগুণ, তিন গুণ, চার গুণ করতে হবে। ইদানীং নতুন গান করছেন না? কবিতা দিচ্ছেন নিয়মিত…নতুন গান তৈরি করছি, সেগুলো মাঠে-ময়দানে গাইছিও। সময়মতো প্রকাশও করব। গান নিয়ে আমি তাড়াহুড়া করি না। কবিতার জায়গাটা আরাম লাগে।

আগে ভাবতাম, যা-ই লিখি, সুর করতে হবে। ফলে একটা বাড়তি চাপ পড়ে যেত। নিজের পছন্দের সুরটা করতে কিছুটা সময় লাগে। অন্যদিকে হরহামেশা মাথায় কথা আসে, সেগুলো কবিতা কিংবা ছন্দে মিলিয়ে লিখে ফেলি।

আগে এগুলো প্রকাশ করা হতো না, এখন করি, এই আর কি। প্রতিনিয়ত আমার ফেসবুক পেজে হুমকি, গালাগাল আসে। এসবের তো জবাব দেওয়া সম্ভব নয়। তবে সামগ্রিকভাবে নিজের একটা বক্তব্য, প্রতিক্রিয়া বা আলাপচারিতা থাকে। আমি তো বন্দুক দিয়ে খেলব না, খেলব গান-কবিতা দিয়ে। এটাই আমার কাজ এবং বেশ মজা লাগে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker