জাতীয়

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে বাংলাদেশের যত অর্জন

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম চীন সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি বা অর্জন কী সেটি নিয়ে চলছে নানা হিসাবনিকাশ।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম দ্বিপাক্ষিক এই সফরে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক, এবং সম্পর্ক ‘নতুন উচ্চতায়’ নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে যৌথ বিবৃতিতে। বিশ্লেষকেরা এ সফরকে একটি সফল সফর বলে মনে করছেন।

বাণিজ্য-অর্থনীতি ও বিনিয়োগ গণঅভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এমন এক সময়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়েছেন যখন দেশের অর্থনীতি নানামুখী চাপে রয়েছে।

ফলে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য। সে জায়গা থেকে এই সফর নিয়ে শুরুতেই আলোচনা ছিল। এই সফরে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি সই হয়েছে।

এছাড়া সাহিত্য ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনিময় ও সহযোগিতা, সংবাদ বিনিময়, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে আটটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ।

আলোচনায় মোংলা বন্দরের উন্নয়নে কাজ করার কথা বলেছে চীন। যদিও আগে থেকেই চীন ও ভারত আলাদাভাবে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত ছিল। নতুন করে পুরো কাজ এখন চীন করতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

স্বাস্থ্য সেবায় নতুন গন্তব্য গত আগস্টে পট পরিবর্তনের আগে অনেক বাংলাদেশি স্বাস্থ্য সেবার জন্য ভারতে যাতায়াত করতেন। কিন্তু তার পর থেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারতের চিকিৎসাসহ সব ধরনের ভিসা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। চীন এই সুযোগে এগিয়ে এসেছে।

শনিবার চীনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এক বিবৃতিতে জানায়, চীন এরই মধ্যে কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ করেছে। চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে চীনের কুনমিং পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে।

এর ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ সহজে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুনমিংয়ের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারবেন, বলে বিবৃতিতে বলা হয়। এর বাইরে, বিশ্লেষকরা বলছেন, অধ্যাপক ইউনূসের এ সফরে নতুন যা হয়েছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য সেবা খাতে বেশ কিছু বিষয় এসেছে, যা আগে কখনো এত বিস্তারিতভাবে আলোচনায় আসেনি।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন, “ঢাকায় কিছু হাসপাতাল গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। চীন রোবটিক ফিজিও থেরাপির কথা বলেছে। কার্ডিও ভাস্কুলার সার্জারি এবং ভেহিকেল সাপ্লাই দেয়ার কথা বলেছে। যেটা হয়তো বিশাল কিছু না, তবে স্বাস্থ্য খাতে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক সাহায্য করবে।”

তিনি বলেন, “এখন থেকে চীনের কুনমিংকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এটা নতুন মাত্রা তৈরি হচ্ছে। তার মানে এই না যে মানুষ ভারত যাবে না।”

তিস্তা ও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, শত শত বিস্তৃত নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য চীন থেকে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস।

প্রধান উপদেষ্টার সফরের পর বাংলাদেশ ও চীনের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনঃসংস্কার প্রকল্পে চীনা কোম্পানিগুলোর অংশগ্রহণকে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে।

সফরে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নদী শাসন ড্রেজিংসহ বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ২০২১ সালে চীন তিস্তা নদীর ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছিল।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আশা এ বছরই বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হতে যাচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একে একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

এই সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় চীনকে আরও জোরালো ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

২০১৭ সালে বাংলাদেশে প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরে বিভিন্ন সময় আরও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে এর আগে শেখ হাসিনার সরকার উদ্যোগ নিলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সাথে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক চীনের। মিয়ানমারে চীনের বহু প্রকল্প রয়েছে। সেক্ষেত্রে চীনকে রাজি করানো গেলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। “চীনা প্রেসিডেন্ট বলেছেন দুই পক্ষকে নিয়েই তারা এ উদ্যোগ নেবে। চীন উদ্যোগ নিলে সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব,” যোগ করেন তিনি।

তাইওয়ান ইস্যু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর মধ্যে বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দুই দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, ‘এক চীন’ নীতির প্রতি সমর্থনের কথা ব্যক্ত করে তাইওয়ানকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন তাইওয়ান মূলত দক্ষিণ চীন সমূদ্রের একটি দ্বীপ। কিন্তু, তাইওয়ান কি চীনের অংশ, না চীন থেকে আলাদা – এ নিয়ে পক্ষভেদে সংশয় দেখা যায়। চীনের পক্ষ থেকে যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ব্যাপারে নিজেদের অঙ্গীকারের কথা। অন্তর্বর্তী সরকারের পথচলায় সমর্থনের কথাও ব্যক্ত করা হয় এতে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker