অর্থনীতি

প্রবাস আয়ের বৈশ্বিক ধারায় বাংলাদেশের অবস্থান

গত ৭ মে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এই প্রথম সদর দপ্তর জেনেভার বাইরে ঢাকায় তাদের দ্বিবার্ষিক বিশ্ব অভিবাসন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন আইওএমের মহাপরিচালক অ্যামি পোপ। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ সালে বৈশ্বিক প্রবাস আয় ছিল ১২৮ বিলিয়ন ডলার, যা বেড়ে ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৮৩১ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ ২২ বছরে প্রবাস আয় বেড়েছে ৬৫০ শতাংশ।

এর মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর আয় ছিল ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার। আইওএমের মহাপরিচালক বলেন, আন্তর্জাতিক অভিবাসন এখনো মানব উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ঢাকাকে প্রতিবেদনটি প্রকাশের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে অভিবাসন সমস্যা মোকাবেলা করা এবং অভিবাসীদের অধিকার রক্ষা নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ, নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে গ্লোবাল কম্প্যাক্টের চ্যাম্পিয়ন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার জোরালো অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে, যা আইওএমের কৌশলগত লক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। 

আইওএমের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ষষ্ঠ অভিবাসী কর্মী প্রেরণকারী দেশ হলেও রেমিট্যান্স প্রাপ্তির দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে।

২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্ত রেমিট্যান্স ছিল ২১.৫০ বিলিয়ন ডলার। প্রথম স্থানে থাকা ভারতের রেমিট্যান্স ছিল ১১১.২২ বিলিয়ন ডলার, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মেক্সিকো ৬১.১০ বিলিয়ন, তৃতীয় অবস্থানে চীন ৫১ বিলিয়ন, চতুর্থ অবস্থানে ফিলিপাইন ৩৮.০৫ বিলিয়ন, পঞ্চম অবস্থানে ফ্রান্স ৩০.০৪ বিলিয়ন, ষষ্ঠ অবস্থানে পাকিস্তান ২৯.৮৭ বিলিয়ন এবং সপ্তম অবস্থানে থাকা মিসরের রেমিট্যান্স ছিল ২৮.৩৩ বিলিয়ন ডলার। প্রাপ্ত তথ্য মতে, রেকর্ডসংখ্যক প্রায় ১২ লাখ কর্মী পাঠিয়েও ২০২৩ সালে বাংলাদেশ রেমিট্যান্স হিসেবে পেয়েছিল ২১.৮২ বিলিয়ন ডলার।

২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২১.৫০ বিলিয়ন ডলার এবং অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার।

অন্যদিকে ভারত ২০২২ সালে ১৩ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্স পেয়েছিল ১১১.২২ বিলিয়ন ডলার। প্রথম স্থানে থাকা ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে দুই দেশ থেকে প্রতিবছর পাঠানো কর্মীর সংখ্যার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য না থাকলেও বাংলাদেশের রেমিট্যান্স ছিল ভারতের এক-পঞ্চমাংশ। অর্থাৎ অভিবাসীর সংখ্যা বাড়লেই সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে তেমনটি নয়। মূলত রেমিট্যান্স আসে প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাসরত ও অস্থায়ীভাবে কর্মরত একটি দেশের সব নাগরিকের কাছ থেকেই। যেমন—একটি বছর বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের মোট সংখ্যা, অধিক আয়ের দেশে বাংলাদেশি অভিবাসীর হার, তাদের মধ্যে দক্ষ বাংলাদেশির হার এবং অর্জিত আয়ের কত অংশ বৈধ পথে প্রেরণ করে, সেসবের ওপর রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নির্ভর করে।

অর্থাৎ দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অধিক আয়ের দেশে কর্মী প্রেরণ এবং অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করা গেলে রেমিট্যান্স বাড়বেই। এই তিনটি বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ যে বর্তমানের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

এদিকে মালয়েশিয়ায় যাওয়া আমাদের অভিবাসীদের নিয়ে গত ২ মে কালের কণ্ঠে ‘মালয়েশিয়ায় প্রতারিত শ্রমিকদের দুর্দশা দেখার জন্য স্বাধীন সংস্থার প্রয়োজন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পড়ে যতটুকু বোঝা গেল তা হলো, মালয়েশিয়ায় ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে নিয়োগ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো হয়েছে। ওই সব কর্মীর প্রত্যেকে রিক্রুটিং এজেন্টদের কমপক্ষে ২৫ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত দিয়েছে, যা তাদের ঋণ করতে হয়েছে। কোনো কাজ না থাকায় আয়ও হচ্ছে না, অথচ ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে। ফলে তারা মানসিক অশান্তি ও হতাশায় ভুগছে। এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ, অর্থাৎ উভয় দেশের লোকজন জড়িত রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে যেসব এজেন্ট কর্মী প্রেরণ করেছে, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ওই এজেন্টদের সম্পর্কে জানে। অন্যদিকে অভিবাসন ব্যয় একটা গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। শুধু অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দিলেই সরকারের দায়িত্ব পালন করা হয় না, যথাযথ মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা আবশ্যক। একটা কথা মনে রাখতেই হবে যে অভিবাসী কর্মিবান্ধব পদ্ধতি অনুসরণ করা ছাড়া স্বল্প অভিবাসন ব্যয় নিশ্চিত করা যেমন কখনো সম্ভব নয়, তেমনি মালয়েশিয়ার মতো অন্যান্য দেশে উদ্ভূত অভিবাসী কর্মীদের দুর্দশা ও পীড়ন থেকে বাঁচানোর কোনো পথও খোলা নেই।

গত ৮ মে সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে আমাদের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদে আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লাখ কর্মীকে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি আরো জানান, অধিক হারে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত ১৭৬টি দেশে কর্মী পাঠানো হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তাঁদের পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ এবং প্রশংসনীয়। গত বছর প্রেরিত অভিবাসী কর্মিসংখ্যার আলোকে বলা যায়, আগামী পাঁচ বছরে ৬০ বা ৭০ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানো অসম্ভব কিছু নয়। ফলে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ কিছুটা বাড়তেও পারে, যেমনটি ২০২৩ সালে সামান্য বেড়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রতিবেশী ভারত আমাদের প্রেরিত কর্মিসংখ্যার সমান কর্মী পাঠিয়ে কিভাবে আমাদের থেকে চার-পাঁচ গুণ রেমিট্যান্স অর্জন করে, তা জানা। সেই বিষয়টি নিয়ে আমরা কেন ভাবছি না? সেই উত্তরটির মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। শুধু কর্মী প্রেরণের সংখ্যাই নয়, বিশ্ব শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী প্রেরণে গুরুত্ব দিতে হবে।

আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে বিশ্ব শ্রমবাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এবং পরিবর্তনশীল। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই নেতিবাচক জন্মহার পরিলক্ষিত হচ্ছে, যুবক শ্রেণির লোকসংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে। অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশেই কৃষি, নির্মাণ, পরিচ্ছন্ন ইত্যাদি ক্ষেত্রের কাজগুলো করার জন্য স্থানীয় লোকবলের অভাব দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। আবার অনেক দেশে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি সংশ্লিষ্ট কাজের লোকজনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি ওই সব তথ্য সংগ্রহ করে আমাদের বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের সেসব চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি? আমরা কি ওই সব দেশে আমাদের প্রশিক্ষিত কর্মীদের প্রেরণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি? একদিকে আমাদের সেই দক্ষ কর্মিবাহিনী প্রস্তুত করে রাখতে হবে, অন্যদিকে আমাদের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অধিক আয়ের সেসব বাজার ধরতে হবে এবং আমাদের কর্মীদের অভিবাসী কর্মিবান্ধব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সেসব দেশে প্রেরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমাদের যতই বিলম্ব হবে, আমাদের অভিবাসী কর্মীদের দুর্ভোগ ততই বাড়বে এবং সর্বশেষে আমাদের রেমিট্যান্স প্রাপ্তির পরিমাণ বর্তমানের মতোই হোঁচট খাবে।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker