রেললাইন থেকে গত পাঁচ বছরে চার হাজার ৩৪৫ জনের লাশ উদ্ধার করেছে রেলওয়ে পুলিশ। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে এসব লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক তদন্তে ৭৫ জনকে হত্যার করা হয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। রেলওয়ে পুলিশ বলছে, হত্যার ঘটনা ধামাচাপা দিতে খুুনিরা রেললাইনে এভাবে লাশ ফেলে যায়।
ওসি বলেন, রেললাইন থেকে লাশ উদ্ধারের পর প্রথমে অপমৃত্যু মামলা করা হয়। এরপর সেই মামলা তদন্তের পর হত্যার অভিযোগ পেলে অপমৃত্যু মামলা হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
রেলওয়ে পুলিশ সূত্র বলছে, গত পাঁচ বছরে রেললাইন থেকে উদ্ধার করা লাশের মধ্যে ৭৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে মামলা করা হয়েছে। নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন থেকে গত ১৮ এপিল সকালে তৌহিদুল ইসলাম খোকন (৩০) নামের এক পিকআপ ভ্যানচালকের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। উদ্ধারের আগে ওই রেললাইনে ট্রেন চলাচল না করায় লাশটি সেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়নি।
একই সঙ্গে খোকনের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, এটি হত্যাকাণ্ড। রেল পুলিশ বলছে, অন্য কোথাও খুন করে রেললাইনে এভাবে যুবকের লাশ ফেলে রাখার উদ্দেশ্য হলো, সবাই ভাববে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।
রেল পুলিশ বলছে, খুন করার পর আলামত নষ্ট করতে লাশ রেললাইনের ওপর ফেলে রাখার এ ঘটনা নতুন নয়। মূলত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আড়াল করে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে দুর্বৃত্তরা এই কৌশল বেছে নেয়। তা ছাড়া ট্রেনে কাটা পড়লে ক্ষতবিক্ষত লাশ শনাক্ত করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে যায়। তখন তদন্তকাজও জটিল হয়ে যায়।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, যে ৭৫ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, এর মধ্যে ৫৬ জনের লাশ উদ্ধারের পর আলামত দেখে সরাসরি খুনের মামলা করা হয়েছে। বাকি ১৯ জনের ক্ষেত্রে প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। পরে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে তারা হত্যাকাণ্ডের শিকার। এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
রেল পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে খুনের ঘটনা আরো অনেক বেশি হবে। তদন্তের দুর্বলতা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকা, লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে না পারা—এসব কারণেও অনেক খুনের ঘটনা শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে অপমৃত্যু মামলা করা হয়।
প্রতি মাসে গড়ে ৭২ লাশ উদ্ধার
রেললাইন থেকে গত পাঁচ বছরে যেসব লাশ উদ্ধার করা হয়, এর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩ সালে এক হাজার ৩৭টি, ২০২২ সালে এক হাজার ৫৬টি, ২০২১ সালে ৬০২টি, ২০২০ সালে ৬৯৫টি ও ২০১৯ সালে ৯৫৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সে হিসাবে এই সময়ে প্রতি মাসে ৭২টি লাশ উদ্ধার করা হয়। মূলত রেললাইন ধরে অসতর্কভাবে হাঁটা, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে যাতায়াত করা, রেললাইনে বসে থাকা, ট্রেনের ছাদে ভ্রমণ করা, ট্রেন আসার সময় তাড়াহুড়া করে লেভেলক্রসিং পার হওয়া এবং চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে বেশির ভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
রেলওয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, রেললাইন পার হওয়ার সময় কানের চেয়ে চোখকে বেশি কাজে লাগাতে হবে। কারণ চারপাশের নানা শব্দে ট্রেনের হুইসল বা ইঞ্জিনের শব্দ কানে না-ও যেতে পারে। তাই দুই দিক দেখে রেললাইন পার হতে হবে।
এসব বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি-অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) মো. শাহ আলম বলেন, রেললাইন থেকে উদ্ধার প্রতিটি লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এতে হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়া গেলে হত্যা মামলা করা হয় এবং এ ব্যাপারে তদন্তও করা হয়।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, অপরাধের দায় এড়াতে খুনের পর লাশ রেললাইনে ফেলে রাখছে দুর্বৃত্তরা। তাদের মূল উদ্দেশ্য, খুনের ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া। এ ক্ষেত্রে পুলিশকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। একই সঙ্গে তদন্তসংশ্লিষ্টদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অপমৃত্যু কমাতে পথচারীদের রেলপথ ব্যবহারে আরো সতর্ক হতে হবে।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts to your email.