ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট জেলার ১৩ উপজেলা ও সিলেট সিটি করপোরেশন কমবেশি বন্যাকবলিত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বন্যাকবলিত গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। বন্যায় এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় পৌনে চার লাখ মানুষ। জেলার সব পয়েন্টে নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরো খারাপের শঙ্কা করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৮ জুন) ভোর ৬টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫৩ মিলিমিটার। আজ সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৬ মিলিমিটার। এর মধ্যে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায়ই বৃষ্টিপাত হয়েছে ৪৪ মিলিমিটার।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেট কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব হোসেন জানান, সিলেটের বৃষ্টিপাতের চেয়েও স্থানীয়দের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে আছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেরাপুঞ্জি ও মেঘালয়ের ভারি বৃষ্টিপাত। সেখানকার অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত শেষ পর্যন্ত বিপর্যয়ে ফেলতে শুরু করেছে সিলেটের উপজেলাগুলোকে।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের ওয়েব সাইট আইডিএমের তথ্য মতে, সোমবার থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৯৫ সেন্টিমিটার। সেখানে আগামী বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনে এক হাজার ৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের শঙ্কা রয়েছে। এমনটা হলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতিতে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের ১১ পয়েন্টের মধ্যে ৬ পয়েন্টেই নদীর পানি বিপৎসীমার অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার, কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদী জকিগঞ্জের অমলসিদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে বিপৎসীমার ৮৮ পয়েন্ট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া জৈন্তাপুর উপজেলার সারি পয়েন্ট সারি নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার এবং গোয়াইনঘাট উপজেলায় সারি গোয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার ২৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ ছাড়াও শেরপুরে কুশিয়ারা নদী, কোম্পানীগঞ্জে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
নদীর পানি বেড়ে সিলেট নগরের উপশহর, তেররতন, মেন্দিবাগ, সোবহানীঘাট, যতরপুর, তালতলা, এলাকার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। নগরের অনেক প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কে পানি রয়েছে। ওসমানী বিমানবন্দর সড়ক, সিলেট-তামাবিল সড়কের বিভিন্ন অংশ, দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোডসহ বিভিন্ন সড়কের বেশ কয়েকটি স্থান জলমগ্ন হয়ে আছে।
উপজেলাগুলোতে বাড়ছে পানি
বন্যায় সিলেটের ১৩ উপজেলার ৮৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন এবং কানাইঘাট উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলাগুলোর ৮৪৯টি গ্রাম বন্যাক্রান্ত হয়ে তিন লাখ ৬১ হাজার ৫০৭ জন মানুষ বন্যাকবলিত। এসব উপজেলায় ৬১৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন হাজার ৯২৪ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
বন্যাকবলিত গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ। বন্যাকবলিতদের সাহায্যে উপজেলা প্রশাসন হেল্প লাইন চালু করেছে। মঙ্গলবার (১৮ জুন) ভোররাত থেকে সকালের মধ্যে উপজেলার বেশির ভাগ অংশ তলিয়ে যায়। উপজেলার ৩১৩টি গ্রামের মধ্যে ২০৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়। এতে এক হাজার ৫০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলা প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের সঙ্গে গোয়াইনঘাট উপজেলার এবং গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়নগুলোর সড়ক যোগাযোগ ভেঙে পড়েছে। উপজেলার সড়ক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলা চলে। গোয়াইনঘাট-সারিঘাট সড়ক, গোয়াইনঘাট-জাফলং রাধানগর সড়ক, গোয়াইনঘাট-ফতেহপুর হয়ে আসার সড়ক, সালুটির সড়কেও পানি উঠে গেছে। বন্যায় এ পর্যন্ত ৯৮ হাজার মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১৯ হাজার ৭৫০। বন্যার্তদের আশ্রয়ের জন্য উপজেলা প্রশাসন ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছে। ত্রাণ ও উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য ৪৭টি নৌকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
উপজেলার ডৌবাড়ী ইউনিয়নের আটগ্রামের বাসিন্দা ও মানিকগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন, ‘সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে হঠাৎ করে ১৫ থেকে ৭৫ মিনিটের মধ্যে পানি বেড়ে গিয়ে উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবতি হয়েছে। সড়ক ডুবে গেছে। সকালে বেশি পানি বাড়েনি। চার আঙুলের মতো বেড়েছে। আর যদি এক হাত পানি পাড়ে তাহলে বাইশের (২০২২ সালের বন্যা) বন্যার মতো অবস্থায় পড়ে যাবো আমরা।’
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গোয়াইনঘাটের ১৩টি উপজেলার সবকটি প্লাবিত হয়েছে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে উপজেলার ৪৮৩ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ৩১৫ বর্গকিলোমিটার প্লাবিত হয়ে গেছে। ৩১৩ গ্রামের মধ্যে ২০৬টি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত।’
সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উপজেলার সড়ক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলা চলে। গোয়াইনঘাট-সারিঘাট সড়ক, গোয়াইনঘাট-জাফলং রাধানগর সড়ক, গোয়াইনঘাট-ফতেহপুর হয়ে আসার সড়ক, সালুটির সড়কেও পানি উঠে গেছে।’
পানির স্রোত তীব্র হওয়ায় সড়ক, কালভার্ট, সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিচ্ছে বলেও তিনি জানান।
ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। কানাইঘাট সুরমা ও লোভা নদীর পানি হু হু করে বেড়ে যাওয়ার কারণে সম্প্রতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সুরমা নদীর ডাইকের একাধিক ভাঙন দিয়ে প্রবল স্রোতসহ পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। টানা ভারি বর্ষণ ও বন্যা পরিস্থিতি বিরাজ করায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
কানাইঘাট চতুল-দরবস্ত সড়ক, গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক, কানাইঘাট শাহবাগ সড়ক, সুরইঘাট-কানাইঘাট সড়কের নিচু এলাকা দিয়ে বন্যার পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হওয়ায় সিলেটের সাথে কানাইঘাট সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। কানাইঘাট-শাহবাগ সড়কের রামপুরে সম্প্রতি প্রথম দফার বন্যায় ভেঙে যাওয়া সড়কের স্থান পানির তীব্র স্রোতে বিশাল আকারে ভেঙে গিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ রাস্তাঘাট, সুরমা, লোভা ও কুশিয়ারা নদীর পানি অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ায় তলিয়ে গেছে। শত শত বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারজানা নাসরিন বলেন, টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি লোকজন যাতে নিরাপদ স্থানে যেতে পারে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিতে পারে এ জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে নৌকা রাখা হয়েছে।
বিদ্যুতের সাবস্টেশন ঝুঁকিতে
২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার পর এবারও সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার বরইকান্দিতে বিদ্যুতের সাবস্টেশন ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তবে স্টেশনটিতে যাতে নদীর পানি ঢুকতে না পারে এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা যায় সে জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের পাশাপাশি প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী ও সিলেট সিটি করপোরেশন।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) বিকেল ৪টার দিকে সেনাবাহিনীর এক টিম নিয়ে সাবস্টেশনটি পরিদর্শন করেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেছেন, ‘এই সাবস্টেশনে কোনো সমস্যা হলেও তা চালু রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হবে। এ ছাড়া যাতে পানি না ওঠে সে জন্যও কাজ চলছে।’
দক্ষিণ সুরমার বরইকান্দি উপকেন্দ্রটি সিলেটে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ সিলেট-৩-এর অধীন। এই উপকেন্দ্রের মাধ্যমে সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, বরইকান্দি, কামালবাজার, মাসুকগঞ্জ, বিসিক, লালাবাজার, শিববাড়ী ও কদমতলীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালসহ সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ সিলেট-৩ নির্বাহী প্রকৌশলী শ্যামল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘উপকেন্দ্রটি ঝুঁকিতে রয়েছে। পানি ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখনো ওঠেনি। আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনী সাহায্য করবে।’
সিসিকের সব ছুটি বাতিল
সিলেটের নদ-নদীর পানি বেড়ে নগর এলাকার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঈদের ছুটিসহ সব ধরনের ছুটি বাতিল করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) নগরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিসিক মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
দুপুর ১টায় দক্ষিণ সুরমায় সিটি করপোরেশনের ২৮ ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রয়কেন্দ্রে যান সিসিক মেয়র। এ সময় তিনি কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন এবং বন্যাদুর্গতদের জন্য সিসিকের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
এ সময় দক্ষিণ সুরমায় সিসিকের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের টেকনিক্যাল কলেজ রোডসহ কয়েকটি বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। স্থানীয় কাউন্সিলররা তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।