লালমনিরহাট

তিস্তার বাম চ্যানেল বন্ধ করে রাস্তা তৈরি, মহাপরিকল্পনায় বাঁধা, নদীভাঙনসহ ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

নদীর অভ্যন্তরে বিধিবহির্ভূতভাবে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে, তাতে নদীর মারাত্মক ক্ষতি হবে। যে মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, সে সময় নদীটির ভেতরে যে অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে, তাতে নদী, মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি হবে বলে জানিয়েছেন রিভারাইন পিপলসের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন,
যে সময় ‘তিস্তা নদীর সর্বাঙ্গীণ ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার শীর্ষক মহাপরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, ঠিক সে সময় তিস্তার নদীর বাম চ্যানেলে প্রায় দুই কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৫০ ফুট প্রস্থের একটি রাস্তা-কাম-বাঁধ নির্মাণের কারণে চ্যানেলটি প্রায় বন্ধ হতে যেতে বসেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, তিস্তার চ্যানেল বন্ধের কারণে নদীর গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে ভাঙনসহ সম্পদহানি ঘটবে। অবশ্য পাউবোর আশঙ্কা, ইতোমধ্যে সত্যি হচ্ছে বলে সরেজমিন দেখাও গেছে। ‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলন পরিষদসহ নদী গবেষকরা নদীর গতিপথ বন্ধ করে রাস্তা নির্মাণকে সম্পূর্ণ বেআইনি ও তিস্তার সর্বনাশ বলে উল্লেখ করেছেন।
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের নদীবেষ্টিত শৌলমারীতে নির্মাণাধীন একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য অপরিকল্পিত ও বিধিবহির্ভূতভাবে এমন রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, প্রায় চার বছর আগে ৩০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রংপুরের গঙ্গাচড়ায় স্থাপনের জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তবে পরবর্তী সময়ে ইন্ট্রাকোর শেয়ার কিনে নেয় প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেড নামের অপর একটি প্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীতে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ারের সঙ্গে পৃথক দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। চুক্তি অনুযায়ী রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘সৌরপার্ক গড়ে তোলার কথা ছিল। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতিয় গ্রিডে যোগ হবে। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ১২ টাকা ৮০ পয়সা দামে ২০ বছর ধরে কেনার কথা পিডিবির। প্রায় চার বছরেও প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদনে যেতে পারেনি। এখন পিডিবির কাছে স্থান পরির্বতনের আবেদন করেই কালীগঞ্জের শৌলমারীতে কাজ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। আর মূল প্রকল্পে যাতায়াত ও মালামাল পরিবহনের জন্য তিস্তার বাম চ্যানেল প্রায় বন্ধ করে রাস্তা তৈরি কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
পাউবোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২০ মে লালমনিরহাট পাউবোর একটি দল সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরির্দশন করে। প্রতিবেদনে নির্বাহী প্রকৌশলী উল্লেখ করেন, তিস্তা নদীর বাম তীরের প্রায় দুই কিলোমিটার অভ্যন্তরে ইন্ট্রাকো সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করছে এবং প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য নদীর ওপর আড়াআড়িভাবে ৫০ ফুট প্রস্থের একটি রাস্তা ও দুটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে প্রকল্প এলাকাটি একসময় নদীর মূল প্রবাহ ছিল বলেও উল্লেখ করা হয়। বর্তমানে ওই স্থানে নদীটি দুই ধারায় (চ্যানেল) বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যেখানে (বামতীর) রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে বর্ষাকালে প্রায় দেড় কিলোমিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে অন্তত দুটি ধারা প্রবহমান থাকে। এই প্রকল্পের বিষয়ে পাউবোকে কিছুই জানানো হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য বাম চ্যানেল প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলামান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হলে এর কারণে পানির গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙনসহ সম্পদহানি দেখা দিতে পারে। আর বাম চ্যানেলের পানি ডান চ্যানেলের পানির সঙ্গে মিশে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা আরও বিস্তৃত হবে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার সঙ্গেও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সমন্বয় থাকা প্রয়োজন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তাতে পানির গতিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হবে। এতে ডানতীরসহ বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙনসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। এই প্রকল্পের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি ও কোনো মতামত চাওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা নদীর (বাম চ্যানেল) মাঝখানে বেইলি ব্রিজের জন্য কিছুটা জায়গা রেখে রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে। নদী পেরিয়ে চরের বুকে তৈরি ইট বিছানো রাস্তাটি চলে গেছে প্রকল্প এলাকায়। বালুভর্তি শত শত জিও ব্যাগ রেখে দুই পাশে ইট-রড দিয়ে ‘সাইড ওয়াল তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার কারণে চরের মাঝে পানি আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে অনেক জমিতে। ফলে সেখানে এখন পর্যন্ত আমনের চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি।
তিস্তাতীরবর্তী বিভিন্ন এলাকার অনেকে অভিযোগ করেছেন, রাস্তা বা বাঁধের কারণে পানি বাধাগ্রস্ত হয়ে এর উজানে কালীগঞ্জের দুটি ও পাশের হাতীবান্ধা উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে অনেকে বসতবাড়িসহ আবাদি জমি হারিয়ে ফেলছেন।
আরও দেখা গেছে, দক্ষিণ ভোটমারী গ্রামের নদীতীরবর্তী এলাকার বিস্তীর্ণ আবাদি জমি ইতোমধ্যে চলে গেছে। গ্রাম থেকে চরের দিকে যাওয়া একটি কাঁচা রাস্তারও অনেকাংশ ভেঙে গেছে পানির চাপে। ধীরে ধীরে নদী এগিয়ে আসছে গ্রামের দিকে।
কালীগঞ্জ উপজেলার তিস্তা পাড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী বলেন, ভাটিতে বাঁধ দেওয়ায় নদীর পানি আটকে আমাদের এলাকার জমিজমা নদীতে চলে যাচ্ছে। আমন ক্ষেতসহ জমিজমা এখন যেন নদীর রূপ ধারণ করেছে। আমাদের মতো গরিব মানুষের এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই। একই এলাকার শাহিনুর আলম বলেন, আমাদের উজানের জমিজমা সব শেষ হয়ে যাচ্ছে ইন্ট্রাকোর রাস্তা নির্মাণের কারণে।
চারবাসীরা জানান, প্রায় দুই কিলোমিটার রাস্তার কারণে পানি আটকে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, এ জলাবদ্ধতার কারণে এবার অনেকে নিজের জমিতে আবাদ করতে পারেননি। শৌলমারী গ্রামের গৃহবধূ আমিনা বেগম বলেন, ভয়ভীতি দেখিয়ে একদিকে আমাদের জমি যেমন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে বাকি জমিতেও আবাদে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
‘তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলন পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, এসব প্রকল্প করে আমাদের জীবনকে ধ্বংস করছে, মানুষকে বিপর্যস্ত করছে। অথচ পানি উন্নয়ন বোর্ড আর প্রশাসন কিছুই জানে না।
ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেডের পক্ষে প্যারামাউন্ট বিট্র্যাক এনার্জি লিমিটেডের কর্মকর্তা মেজবা আজিজ সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, নদীর বুকে রাস্তা নির্মাণে গতিপথের কোনো ক্ষতি হবে না। নদীর পানি যাতে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে, সে জন্য দুটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করা হবে।
জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটি সূত্র জানায়, তিস্তার বামতীর অপরিকল্পিতভাবে বন্ধের বিষয়টি গত ১৩ জুন জেলা পানিসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় তুলে ধরেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পাউবো)।
তিনি জানান, সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে নদীর বামতীর আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এ বিষয়ে পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির ‘অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে কি না, সেটাও পাউবোকে জানানো হয়নি। এই সভাতেও ভবিষ্যৎ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার অনুরোধ জানান তিনি। একটি কমিটি গঠন করে সরেজমিনে তদন্ত শেষে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
ওই কমিটির সদস্য ও কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল মান্নান বলেন, এই কমিটিতে আমাকে রাখা হয়েছে কি না, তা আমি কিছুই জানি না। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছি। এর বাইরে আমার কিছু বলার নেই।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker