নওগাঁ

নওগাঁয় সমিতির গ্রাহকদের সড়ক অবরোধ, টাকা ফেরতের দাবি

তাদের মধ্যে কেউ বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন, কেউ ভ্যানচালকের স্ত্রী, কেউ গৃহিণী বা দিনমজুর, আবার কেউ অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
এই সকল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কষ্টে অর্জিত টাকা লাভের আশায় জমা করেছিলেন ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সমবায় সমিতিতে। কেউ এককালীন টাকা দিয়ে মাসে মাসে লাভ নিচ্ছিলেন, কেউবা মাসে মাসে টাকা জমা করছিলেন।
কিন্তু তাঁদের সেই আশায় এখন ‘গুড়েবালি’। সমিতির মূল ক্রীড়নকই পরিবারসহ পালিয়ে গেছেন। সঙ্গে নিয়ে গেছেন গ্রাহকদের টাকা।
টাকার দাবিতে কয়েকশ নারী-পুরুষ রোববার (১ ডিসেম্বর) নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড়ে প্রধান সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে চলা এই অবরোধে সৃষ্টি হয় যানজট।
এ সময় গ্রাহকেরা বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন (তনু)-কে গ্রেফতারের দাবি জানান।
১ ডিসেম্বর রবিবার সকালে সাড়ে ১০টার দিকে মুক্তির মোড়ে শহরের প্রধান সড়কের ওপর বসে পড়েন ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা।
দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন এসে নাজিম উদ্দিনকে গ্রেফতারের আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে চলে যান।
Image
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, নাজিম উদ্দিন পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা নওগাঁ সদর থানা ও নওগাঁ আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করেছেন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তাদের কাছেও একাধিকবার অভিযোগ দিয়েছেন।
তবে, সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা এখনও নাজিম উদ্দিনকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ অবস্থায় তাঁরা নিজেদের টাকা উদ্ধারের দাবিতে সড়ক অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে ভুক্তভোগীরা তাঁদের প্রতারিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী, নওগাঁ ছাড়াও পাশের জয়পুরহাট, রাজশাহী এবং বগুড়া জেলায় বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন নামের সমবায় সমিতির প্রায় ৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে।
এর মধ্যে ৪ হাজার ৩০০ গ্রাহকের পাওনা টাকার হিসাব করা হলে ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার হিসাব পাওয়া গেছে। সব সদস্যের পাওনা টাকার পরিমাণ জানলে এই টাকার পরিমাণ আরও বেশি হবে।
ভুক্তভোগী গ্রাহকেরা জানান, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন ২০০৯ সাল থেকে নওগাঁর বিভিন্ন এলাকায় অফিস খুলে ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করছিল।
পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থাগুলোর চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ এবং স্থায়ী আমানতের বিপরীতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা জমা রাখতে শুরু করে সমিতির কর্মকর্তারা।
টাকা জমা রেখে গ্রাহকদের প্রতি মাসে মুনাফা দেওয়ার কার্যক্রম চলছিল। ধীরে ধীরে গ্রাহক সংখ্যা ও আমানতের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, শুরুর দিকে নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে আমানতের বিপরীতে গ্রাহকদের লভ্যাংশের টাকা নিয়মিত দিত প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু গত জুলাই মাস থেকে সমিতির লোকজন গ্রাহকদের আমানত ফেরত ও লভ্যাংশের টাকা দিতে টালবাহানা শুরু করে।
এতে গ্রাহকেরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। মুনাফা ও আমানতের টাকা না পেয়ে কিছু গ্রাহক সেনাবাহিনীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর, গত অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় গ্রাহকদের টাকা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন সংস্থার পরিচালক ও চেয়ারম্যান।
কিন্তু ১২ নভেম্বর সংস্থার সব কার্যক্রম বন্ধ করে রাতের আঁধারে নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ারম্যান পালিয়ে যান। এরপর, ১৫ নভেম্বর বগুড়া শহর থেকে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদকে সেনাবাহিনী আটক করে।
পরে, তাঁকে নওগাঁ সদর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলে, পুলিশ তাঁকে প্রতারণার একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।
সমিতির সদস্য জাহানারা বেগম (৬০) জানান, তাঁর স্বামী পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন। কোন সন্তান নেই। এখন তিনি মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাওয়ার চেষ্টা করেন।
বছর দুয়েক আগে বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া পাঁচ শতক জমি বিক্রি করে ২ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। মানুষের কথা শুনে লাভের আশায় সেই টাকা বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে জমা দেন। শুরুর দিকে মাসে মাসে ৪ হাজার টাকা পেতেন।
সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসা করাতেন ও ওষুধ কিনে খেতেন। কিন্তু গত জুলাই মাস থেকে কোনো মুনাফা পাচ্ছেন না। মুনাফা তো দূরের কথা, মূলধনের ২ লাখ টাকাও ফেরত পাচ্ছেন না।
রাণীনগর উপজেলা বেতগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা জনাব উদ্দিন জানান, তাঁর দুই ছেলে দুবাই প্রবাসী। সেখানে কাজ করে দুই ছেলে বাড়িতে টাকা পাঠায়।
ছেলে-মেয়ে ও নাতিপুতিদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিদেশ থেকে ছেলেদের পাঠানো টাকা থেকে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে ধাপে ধাপে ৬০ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাসে মাসে লাভের টাকাও পেয়েছেন।
তবে, সমিতির কর্মকর্তারা পালিয়ে যাওয়ায় লাভ তো দূরের কথা, সঞ্চিত টাকা ফেরত পাওয়ার দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
নাজিম উদ্দিনের মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
পুলিশ সুপার কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের গ্রাহকদের ন্যায্য পাওনা টাকার বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে।
আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সমিতির নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন গ্রাহকদের ধাপে ধাপে টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি প্রতারণা করে পালিয়ে গেছেন। তাঁকে ধরার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।’

Author

মো: খালেদ বিন ফিরোজ, নওগাঁ প্রতিনিধি

পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি ৩০ মে থেকে মিশন ৯০ নিউজে নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি হিসেবে, সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker