আমে ভরপুর নওগাঁর বাজার, দাম কিছুটা বাড়লেও লোকসানের শঙ্কা চাষিদের
ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে জমে উঠেছে নওগাঁর বৃহত্তম আমের মোকাম সাপাহার বাজার। হিমসাগর, ল্যাংড়া, নাক ফজলি, আম্রপালি, ব্যানানা ম্যাংগো ও বারি-৪ সহ বিভিন্ন জাতের সুস্বাদু আমে বাজার সয়লাব হলেও পর্যাপ্ত ক্রেতা ও পাইকারের অভাবে কাঙ্ক্ষিত দাম মিলছে না। গত কয়েকদিনের তুলনায় আমের দাম কিছুটা বাড়লেও, ভরা মৌসুমে লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমে জমে উঠেছে নওগাঁর সবচেয়ে বড় আমের মোকাম সাপাহার বাজার। বর্তমানে হিমসাগর, ল্যাংড়া, নাক ফজলি, ব্যানানা ম্যাংগো, হাড়ি ভাঙা, আম্রপালি ও বারি-৪ এর মতো সুস্বাদু পরিপক্ব আমে সয়লাব এই আমের বাজার। বাজার ভর্তি আম থাকলেও দেখা নেই পর্যাপ্ত ক্রেতা ও পাইকারদের। ফলে আমের ভরা মৌসুমেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত দাম। তবে গত কয়েকদিনের তুলনায় আমের দাম কিছুটা বাড়লেও এতে লোকসানের আশঙ্কা চাষিদের।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর নওগাঁয় **৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আম চাষ** হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ১২ দশমিক ৭৮ টন হিসাবে জেলায় আম সংগ্রহের মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে **৩ লাখ ৮৭ হাজার ২৩৪ টন**। চলতি মৌসুমে এ জেলায় প্রায় **৪ হাজার কোটি টাকার আম-বাণিজ্যও** আশা করেন স্থানীয় প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ।
নওগাঁর সবচেয়ে বড় আমের মোকাম সাপাহার গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা সদরের গোডাউনপাড়া থেকে জিরোপয়েন্ট, হাসপাতাল রোড থেকে জিরোপয়েন্ট এবং জিরোপয়েন্ট থেকে কলেজ মোড় পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাস্তার দুপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে আমের বাজার। সারি সারি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইঞ্জিনচালিত ভটভটিতে ক্যারেটে আম ভর্তি করে বিক্রির জন্য দাঁড়িয়ে আছে কৃষক। দাম নিয়ে যেন হতাশার শেষ নেই তাদের।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুটি আম ওঠার মধ্য দিয়ে গত **২২ মে** শুরু হয়েছে সাপাহার আমের হাট। বাজারে গোপালভোগ ও ক্ষীরশাপাত আম উঠেছে **২৮ মে** থেকে। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা অনুযায়ী নওগাঁর আম হিসেবে জিআই স্বীকৃতি পাওয়া নাগ ফজলি আম ৫ জুন থেকে বাজারে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে নির্ধারিত সময়ের ৮-১০ দিন আগেই বাজারে উঠতে শুরু করে। নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া আম্রপালি আম প্রশাসনের নির্ধারণ করা সময়সীমা অনুযায়ী ১৮ জুন থেকে বাজারে আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাজারে উঠতে শুরু করে। আম্রপালি আম বাজারে ওঠার পর থেকেই বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়ের অনেক আগেই পাকতে শুরু করেছে ব্যানানা ম্যাংগো ও বারি-৪ আম। ব্যানানা ম্যাংগো আম বাজারে আসার কথা ২৫ জুন এবং বারি-৪ বাজারে আসার কথা ছিল ১০ জুলাই থেকে। অথচ বাজারে মিলছে ব্যানানা ম্যাংগো ও বারি-৪ আম।
প্রচণ্ড গরমের কারণে প্রায় সব জাতের আম নির্দিষ্ট সময়ে ১০-১২ দিন আগেই পাকতে শুরু করায় বাজারে আমের সরবরাহ বেশি হয়। তবে গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাতি ও নাক ফজলি আম বাজারে ওঠার ৪-৫দিন দাম ঠিকমতো পেলেও সময়ের আগেই আম্রপালি ও ল্যাংড়া আম বাজারে উঠতে শুরু করায় দরপতন শুরু হয়। ফলে তাদেরকে গত বছরের চেয়ে অর্ধেক দামে আম বিক্রি করতে হয়। তারমধ্যে দেখা নেই ক্রেতা, পাইকার ও ব্যবসায়ীদের। এতে আমের ভালো দামের আশা করলেও সে আশায় গুড় বালি চাষিদের। তবে বর্তমানে কিছু কিছু আমের দাম বেড়েছে। তারপরও লোকসানের শঙ্কায় আছেন তারা।
সাপাহার বাজারে বর্তমানে আমের দর:
- হিমসাগর: ১,৭০০-২,০০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ১,২০০-১,৮০০ টাকা)
- ল্যাংড়া: ১,৫০০-২,২০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ৮০০-১,৫০০ টাকা)
- নাকফজলি: ১,৫০০-১,৮০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ১,২০০-১,৫০০ টাকা)
- হাড়ি ভাঙ্গা: ২,৫০০-২,৮০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ১,৫০০-২,২০০ টাকা)
- আম্রপালি: ২,৫০০-৪,৫০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ১,৮০০-২,৬০০ টাকা)
- ব্যানানা ম্যাংগো: ৩,২০০-৪,০০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ২,০০০-২,৬০০ টাকা)
- বারি-৪: ১,৮০০-২,২০০ টাকা (২-৩ দিন আগে ১,৮০০-২,০০০ টাকা)
এছাড়াও চাষিরা অভিযোগ করেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবছর কেজি দরে আম কেনার নির্দেশনা দিলেও সেই নির্দেশনা মানছেন না আড়তদাররা। আগের ঢলতা প্রথা অনুযায়ী বাজারে আম বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ কেজিতে মণ দরে। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা।
ফুটকইল গ্রামের আমচাষি ইকবাল হোসেন বলেন, “এবছর আমের ফলন কিছুটা কম হয়েছে। এছাড়াও সার, কীটনাশক, সেচ ও শ্রমিকের খরচ বাড়ায় আম উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। অথচ গত বছরের চেয়ে অর্ধেক দামে এবার আম বিক্রি হচ্ছে। আড়তদারদের কারসাজি ও সিন্ডিকেট করে আমচাষিদের ঠকাচ্ছে।”
সাপাহারের গোডাউনপাড়া এলাকায় বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের স্বত্বাধিকারী তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল বলেন, “এবার সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। সাধারণত ল্যাংড়া, নাগ ফজলি ও গোপালভোগ আম সংগ্রহ শেষ পর্যায়ে আসলে আম্রপালি ও বারি আম-৪ এসব আম বাজারে উঠতে শুরু করে। কিন্তু এবার প্রায় একই সময়ে এসব আম পেকে গেছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে এমনটি হয়েছে।”
উপজেলার তিলনা এলাকার আমচাষি ফিরোজ হোসেন বলেন, “সারাবছর শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে হয় আমবাগানে। অথচ আম বিক্রি করতে এসে আমের সঠিক দাম বলছে না ব্যবসায়ীরা। আবার পাইকারের সংখ্যাও কম এবছর। এতে খরচই উঠবে না, লাভ তো দূরের কথা।”
আইহাই এলাকার আমচাষি নাজমুল হাসেন বলেন, “প্রতিদিন মাইকিং করা হচ্ছে আম বিক্রির সময় ওজনে বেশি না নেওয়া জন্য। তারপরও ৫০-৫২ কেজিতে মণ নিচ্ছেন আড়দদাররা। একে তো এবছর আমের দাম কম তার ওপর ওজনে বেশি নেওয়ায় আর্থিকভাবে আরও ক্ষতি হতে হচ্ছে।”
সাপাহার উপজেলা আম আড়তদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন রিফাত বলেন, “এ বছর ফলন কম হলেও আমের সাইজ অনেক ভালো হয়েছে। ব্যবসায়ী এবং পাইকাররা ইতোমধ্যে আসতে শুরু করেছেন। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের নির্দেশনা অনুযায়ী কেজিতে আম ক্রয়ের জন্য ব্যবসায়ীদের বলা হয়েছে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং কানসাটের ব্যবসায়ীরা ৫০ থেকে ৫২ কেজিতেই মণ হিসেবে আম ক্রয় করছেন। যার কারণে এ বাজারে আম ক্রয় করতে আসা ব্যবসায়ীরা লোকসানের মুখে পড়ছেন। তাই বাধ্য হয়ে বেশি নিচ্ছে।”
নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, “সাধারণত ল্যাংড়া আম জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাজারে আসে। কিন্তু এবার এ আম মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাজারে আসতে শুরু করে। এরপর আসে আম্রপালি আম। নওগাঁয় সবচেয়ে বেশি চাষ হওয়া আম্রপালি বাজারে আসে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে। কিন্তু এবার এ আম মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বাজারে এসেছে। এখন তো শুনছি বারি আম-৪ ও ব্যানানা ম্যাঙ্গো আমও পাকতে শুরু করেছে। এগুলো সাধারণত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে কিংবা জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজারে আসে। গরমে আম আগাম পেকে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষিরা।”