স্বপন মাহমুদ, জামালপুর প্রতিনিধি:
বাপ গো ত্রিশ বছরে কয়েকবার নদী ভাঙার শিকার হয়েছি। নদী পেটে যহন ঘরবাড়ি চলে যায় বুকের মধ্যে ধুকধুক শুরু হয়। স্বপ্নের ঠিকানা যখন ভাঙে তখন চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমাগো আর কোন উপায় থাকেনা। নদীর পাড় ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে আমাগো সাজানো স্বপ্নগুলোও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। শেষ একটু সম্বল ছিলো, সেটাও এখন নদী গর্ভে চলে গেলো। মাথাগুঁড়ার ঠাঁই আর থাকলোনা। আল্লা তুমি ছাড়া আমাদের আর গতি রইলোনা গো। ঘরবাড়ি নদী গর্ভে চলে যাওয়ায় ভাঙনের পাড়ে বসে এভাবেই কান্নায় বিলাপ করছে শতবর্ষী বৃদ্ধা বানিছা বেগম।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) বিকালে জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের মিরকুটিয়া কাঁঠালতলা ভাঙন কবলিত এলাকায় গিয়ে চোখে পড়ে এমনি দৃশ্য। শতবর্ষী বৃদ্ধা বানিছা বেগম। স্বামী মকবুল হোসেন মারা যাওয়ার পর স্বামীর বসতভিটায় দুচালা দুটি ঘর বানিয়ে পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে যমুনা নদীর পাড় এলাকায় বসবাস করে আসছিল সে।
গত কয়েকদিনে যমুনার পানি বেড়ে তীব্র ভাঙনে বিলিন হয়ে যায় তার শেষ সম্ভব স্বামীর বসতভিটা। ঘরবাড়ি নদী গর্ভে চলে যাওয়ার ভাঙনের পাড়ে বসে কান্নায় বিলাপ করছে বৃদ্ধা বানিছা বেগম। যমুনার তীব্র ভাঙনে বানিছার মতো গৃহহীন হয়ে পড়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার।
শেষ সম্ভব হারানো বিলকিস বেগমের সাথে কথা হয়। বিলকিস বেগম বলেন, বিয়ে হয় পিংনার নলসন্ধা গ্রামে। ১০ বছর আগে যমুনার তীব্র ভাঙনে স্বামীর বসতভিটা নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায়। স্বামীর আর কোনো জায়গা জমি না থাকায় স্বামী সন্তান নিয়ে বাবার গ্রামে চলে আসেন তিনি। গত দুইদিনে বাবার বসতভিটাও যমুনা নদী খেয়ে ফেললো। স্বামী সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মা নিয়ে কই আশ্রয় নিবো এখন। সেই চিন্তায় প্রহর গুনছি এখন।
কথা হয় বৃদ্ধ এক দোকানদার রহিম মন্ডলের সাথে, কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, তিন শতাংশ জায়গাই সম্ভব ছিলো আমার। নদীতে মাছ শিকার করে তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে চলতাম। বয়স হয়ে গেছে আগের মতো আর নদীতে মাছ ধরতে পারিনা। থাকার ঘরের সাথেই একটা মুদির দোকান দিয়ে সেখান থেকে যা আয় হতো কোনমতে দিন পারি দিতাম। দুইদিন আগে সেই সম্ভবটুকুও সর্বনাশা যমুনার গর্ভে চলে গেলো। আর তো কোনো মাথা গুজার ঠাঁই থাকলোনা। এখন কই যাবো আর কি খাবো? প্রধানমন্ত্রী দয়া না করলে নদীতে পড়ে মরণ ছাড়া গতি নাই। বানিছা, বিলকিস বেগম ও রহিম মন্ডের মতো আরো অনেকেই ভাঙনের পাড়ে বসে বসে নিজেদের স্বপ্নগুলো ভেসে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে আর যমুনার জলে মিশছে তাদের চোখের জল। তীব্র নদী ভাঙনরোধে কার্যকরী পদক্ষেপে দেওয়ার জোর দাবি তাদের।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার পিংনা ইউনিয়ন নদী ভাঙ্গন কবলিত ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বহমান যমুনা নদীর করাল গ্রাসে হাজারো পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। অবস্থান নিয়েছে পরিকল্পনাহীন ভবিষ্যত জীবনে আবার অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন অজানা গন্তব্যে। যমুনা নদী যেন এদের পিছু ছাড়ছেই না।
এবারো বন্যা শুরু হতে না হতেই শুরু হয়েছে তীব্রনদী ভাঙ্গন। প্রতি বছর ভাংতে ভাংতে চরাঞ্চলের গ্রাম গুলি বিলিন হয়ে অবশিষ্টি ছিলো মিরকুটিয়া গ্রামের একাংশ কাঠাল তলা এলাকা ‘তাও আজ ভাঙ্গন কবলে। গত কয়েকদিনের তীব্র টানা ভাঙ্গনের ফলে নদীর বুকে বিলিন হয়েছে এ এলাকার, বানিছা বেওয়া, বিলকিস বেগম, রহিম মন্ডল, আফজাল তরফদার, আল আমিন, জাহাঙ্গির, মোতালেব, মিনহাজ, পারভেজ, তারাভানু, চাঁন মিয়াসহ প্রায় অর্ধ শতাধীক পরিবারের ঘরবাড়ী। আবার অনেকেই তাদের ঘরবাড়ী সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্যত্র। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন ফসলের জমি। এ ছাড়াও ভাঙ্গন ঝুকিতে রয়েছে দক্ষিন নলসন্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ,মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অনুপ সিংহ জানান, অব্যাহতভাবে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পিংনা, আওনা, পোগলদিঘা, সাতপোয়া ও কামরাবাদ ইউনিয়ন এলাকায় প্রায় ১৬০ হেক্টর ফসলি জমির পাট,তিল, কাউন, রাধুনি সজ, শাক-সবজিসহ উঠতি ফসল পানিতে নিমজিত হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা।
এ-বিষয়ে জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম জানান, ‘উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত কয়েকদিনে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। পানি কমতে থাকায় উপজেলার পিংনা ইউনিয়নের মিরকুটিয়া কাঁঠালতলা এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে। উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। দ্রত কার্যকরী পদক্ষেপে নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
এব্যাপারে সরিষাবাড়ী আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রশিদ এমপি সাংবাদিকদের বলেন, ভাঙন কবলিত এলাকায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে ভাঙন এলাকায় জিয়ো ব্যাগ ফেলে ভাঙনরোধ করা হবে।