টাঙ্গাইল

ভাঙন আতঙ্কে টাঙ্গাইলের সাত গ্রামের মানুষ নদীর পানি ক্রমাগত বাড়ছে

আব্দুস সাত্তার, প্রতিনিধি,টাঙ্গাইল:

উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে টাঙ্গাইলের সব নদীর পানি ক্রমাগত বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে জেলার দুই উপজেলার সাতটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। প্রমত্ত্বা যমুনার আগ্রাসী রূপে ওই সাতটি গ্রামের মানুষ ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। শুক্রবারও(২১ জুন) বিভিন্ন নদীর পানি ১৮ সেণ্টিমিটার থেকে ৫০ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।

জানাগেছে, যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাতুলি ইউনিয়নের চরপৌলি গ্রামের অরক্ষিত ১৬২৫ মিটার এলাকা এবং ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ইউনিয়নের চিতুলিয়াপাড়া, ভালকুটিয়া, কষ্টাপাড়া ও নিকরাইল ইউনিয়নের মাটিকাটা, পাটিতাপাড়া, কোনাবাড়ী সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে।

এলাকার ভাঙন অভিজ্ঞরা জানায়, কয়েকদিন ধরে যমুনায় পানি বাড়ছে। ক্রমাগত পানি বাড়ার কারণে যমুনা যৌবনা হয়ে উন্মত্তরূপ ধারণের অপেক্ষায় রয়েছে।

বর্তমানে কিছু কিছু এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। যমুনা আগ্রাসী হলে কারো কিছু করার থাকবেনা- মুহূর্তেই বাড়িঘর- গাছপালা সহ কাঁচা বা পাকা স্থাপনা গ্রাস করে ফেলবে।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলি গ্রামের কয়েক ব্যক্তি জানায়, যমুনার ভাঙনে ইতোমধ্যে চরপৌলি গ্রামের অরক্ষিত অর্থাৎ দুইপাশে বাঁধের মাঝখানে খোলা ১৬২৫ মিটার এলাকার ৩৫টি পরিবারের বাড়িঘর ও স্থাপনা নদীগর্ভে চলে গেছে।

ভাঙনে স্থানীয় ৩৫ পরিবারের সবাই শেষ সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। বাড়ি ঘর হারিয়ে কেউ খোলা আকাশের নিচে কেউ অন্যের জমিতে ও বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। ভাঙন কবলিতরা সরকারি- বেসরকারি সাহায্য নয়- তারা যমুনার ওই অংশে বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করার দাবি জানায়।

অপরদিকে, ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী ও নিকরাইল ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একইসঙ্গে নদীতীরে ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত বছরের ভাঙনের পর যেটুকু সম্বল বেঁচে ছিল- তাও ভাঙনের আশঙ্কায় আতঙ্কে দিন পার করছে নদীতীরের শ’ শ’ পরিবার। ইতোমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে।

যমুনা আগ্রাসী রূপ ধারণ করলে সবকিছু তছনছ করে ফেলবে।

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, যমুনার বামতীরে কালিহাতী উপজেলার গড়িলাবাড়ী পাথরঘাট থেকে আলীপুর পর্যন্ত ব্লক দিয়ে বেরীবাঁধ নির্মাণ ও নিউ ধলেশ^রীর নদীর অফটেক(মুখ) বাঁধাই করা হয়েছে। অন্যদিকে,নাগরপুর উপজেলা থেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলির দক্ষিণ পর্যন্ত জিওব্যাগ ও ব্লক ফেলে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে চরপৌলি গ্রামের ১৬২৫ মিটার অংশ অরক্ষিত রয়েছে। বাঁধ না থাকায় ওই অংশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।

সূত্রমতে, টাঙ্গাইলে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি পোড়াবাড়ী পয়েণ্টে ২৪ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার এক দশমিক ১২ সেণ্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলেশ্বরী নদীর পানি এলাসিন পয়েণ্টে ২৫ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এক দশমিক ৪৮ সেণ্টিমিটার, বংশাই নদীর পানি কাউলজানী পয়েণ্টে ১৮  সেণ্টিমিটার বেড়ে ৩ দশমিক ৩৯ সেণ্টিমিটার, একই নদীর মির্জাপুর পয়েণ্টে ১৪ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এক দশমিক ৯৩ সেণ্টিমিটার, ফটিকজানী নদীর পানি নলছোপা পয়েণ্টে ৩৯ সেণ্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার দুই দশমিক ৮৮ সেণ্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর পানি জোকারচর(নিউ ধলেশ^রী) পয়েণ্টে ৫০ সেণ্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার শূণ্য দশমিক ৫৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

নদীতীরের ভাঙন আতঙ্কে থাকা মানুষরা জানায়, গত বর্ষা মৌসুমে ভাঙনরোধে খানুরবাড়ী, চিতুলিয়াপাড়াসহ বিভিন্নস্থানে নামেমাত্র নি¤œমানের জিওব্যাগ ফেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবার সেগুলোও ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রভাব খাটিয়ে নিজ নিজ বাড়ির সামনে জিওব্যাগ ফেলার সুযোগ নেন। দরিদ্র পরিবারের বাড়ির সামনে জিওব্যাগ ফেলা হয় না। গত বর্ষায় নদী ভাঙনের শিকার একাধিক ব্যক্তি জানায়, শুকনো মৌসুমে বালু ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে নদীতে জেগে ওঠা চর কেটে ট্রাকযোগে বিক্রি করে থাকে।

ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে নতুন নতুন এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায় না বা করলেও কোন সুফল পাওয়া যায়না।

তারা জানায়, গত বছর বন্যায় ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফেলা গাইড বাঁধের জিওব্যাগ বালু ব্যবসায়ীদের আনলোড ড্রেজারগুলোর কারণে ধসে যাচ্ছে। ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাকা ও আধা-পাকা সড়ক, গাইড বাঁধ বসত-বাড়ি, মসজিদ-মন্দির, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে।

পাটিতাপাড়ার ওমেছা বেগম, সুফিয়া আক্তার ও কোরবান আলী জানান, যমুনা নদীতে গত কয়েকদিন ধরে পানি বাড়ছে। পানি বৃদ্ধির সঙ্গে ভাঙনও দেখা দিয়েছে।

কিন্তু ভাঙনরোধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। গত বছর বসতভিটা ভেঙে যেটুকু থাকার জায়গা ছিল- তাও এবার চোখের সামনে নদী গর্ভে বিলীনের পথে।

ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মামুনুর রশীদ জানান, কিছুদিন ধরে যমুনায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। ভাঙনরোধে উর্ধ¦তন দপ্তরে অবগত করাসহ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হবে।

টাঙ্গাইল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, যমুনার ভূঞাপুর অংশে ভাঙনের বিষয়টি ইউএনও’র মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে গোবিন্দাসী ও নিকরাইল ইউনিয়নের জন্য একটি প্রকল্প উর্ধ¦তন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকায় ইকোনোমিক জোনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। ইকোনোমিক জোনের কাজ শুরু করা হলে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হয়ে যাবে।

তিনি জানান, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার চরপৌলি গ্রামের উত্তর এবং দক্ষিণের মাঝে ১৬২৫ মিটার অংশ অরক্ষিত রয়েছে। ওই স্থানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। আগামি শুকনো মৌসুমে বাঁধের কাজ ধরা হবে।

Author

আব্দুস সাত্তার, বিশেষ প্রতিনিধি

নাম আব্দুস সাত্তার। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি মিশন নাইনটি নিউজের একজন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker