টাঙ্গাইল

ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরও কলাগাছের শহিদ মিনারে শিশুদের শ্রদ্ধা

টাঙ্গাইল জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা ভাষা আন্দোলনের ৭১ বছর পরও শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ব্যবহার করছে কলা গাছের তৈরি অস্থায়ী শহিদ মিনার। কলা গাছের তৈরি অস্থায়ী শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেন করে শিশুরা বড়দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে দেশাত্বভোধের মহত্ত্ব।

টাঙ্গাইল সদর উপজেলা কাগমারা, এনায়েতপুর, পিচুরিয়া, ধরেরবাড়ী, দুরিয়াবাড়ী, বানিয়াবাড়ী, কোনাবাড়ী, চিলাবাড়ীসহ ১২ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা বাড়ির উঠানে মাটি দিয়ে উঁচু করে কলাগাছ পুঁতে শহিদ মিনার তৈরি করেছে। তাতে বাঁশের কঞ্চি ও রঙিন কাগজ লাগিয়ে সৌন্দর্য্য বাড়িয়েছে। প্রতিটি মিনারের ওপর অপেক্ষাকৃত ছোট কলাগাছের আরো তিনটি টুকরা তির্যকভাবে আটকে রঙিন কাগজ ও নানা রঙের ফুল দিয়ে প্রতিটি মিনার মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চারপাশে সুতা টানিয়ে তাতে রঙিন কাগজ ও বেলুন দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করেছে। শহিদ বেদীতে বুনোফুল, গাঁদা ও গোলাপফুল শোভা পাচ্ছে। পাশেই সাউন্ড সিস্টেমে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। কোথাও কোথাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো শেষে ভোজের আয়োজনও করেছে শিশুরা।

সরেজমিনে জানাগেছ, কলা গাছ দিয়ে শহিদ মিনার তৈরিকারী শিশুদের বয়স ৩ থেকে ১১ বছর। তারা শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও বাবা-মায়ের মুখে এবং বই পড়ে শহিদ দিবস সম্পর্কে জেনেছে। কেউ কেউ এলাকার বড়দের সাথে ইতোপূর্বে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে তারা নিজ হাতে কলা গাছ দিয়ে গড়েছে এই শহিদ মিনার- তারপর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। কেউ বাড়ির গাছের ফুল, কেউ বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজার থেকে ফুল কিনে আবার কেউ বাবাকে দিয়ে ফুল কিনে আনিয়ের কলা গাছের শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

শিশুরা জানায়, অভিভাবক এবং বই পড়ে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য জেনে তারা এমন উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারপর কলা গাছ কেটে ও কঞ্চি এবং মাটি দিয়ে বাড়ির আঙিনায় অস্থায়ী শহিদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা জানায়।

শিক্ষার্থী তাওহীদ মিয়া জানায়, বাবা-মা ও স্কুলের বড় ভাই এবং টিভি দেখে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে জেনেছে। কিভাবে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়, খালি পায়ে প্রভাত ফেরি করতে হয়- তা জানা থাকায় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের আগে দলবেঁধে প্রভাত ফেরিতে গান গেয়েছে।

শিক্ষার্থী কবির হোসেন জানায়, ভাষার মাস শুরু হলেই তারা পরিকল্পনা শুরু করে। কিভাবে শহীদ মিনার বানাবে, কোথায় ফুল পাবে, কে কে তাদের কাজে সহযোগিতা করবে। শহিদ দিবসের আগের দিন থেকে তারা কাজ শুরু করে। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা মিলে একত্রে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

শিক্ষার্থী শরিফ মিয়া জানায়, তাদের মধ্যে কেউ নিজের বাড়ির ফুল আবার অনেকেই বাবাকে দিয়ে শহর থেকে ফুল কিনে এনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। শহীদদের প্রতি জানিয়ে তারা বেশ উৎফুল্ল।

সুমা আক্তার জানায়, তারা জানতে পেরেছে বাংলা ভাষার জন্য রফিক, শফিক, জব্বারসহ অনেকেই শহিদ হয়েছেন। তাদের সম্মানে সকালে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে।

মো: শহিদুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক জানায়, তার ছেলের বায়নার পরিপ্রেক্ষিতে তিন বছর যাবত শহিদ দিবসের আগের দিন শহর থেকে ফুল কিনে আনতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে তার ছেলে কলা গাছের শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। তিনি মনে করেন, এতে শিশু কাল থেকে তারা ভাষা শহিদ, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হচ্ছে। তিনি গ্রামের স্কুলে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। কিন্তু ছেলেকে সাথে নিয়ে যাননি।

শিক্ষক তন্ময় হাসান জানায়, গ্রামে কোন স্থায়ী শহীদ মিনার না থাকায় সকালে শিশুরা নিজেদের তৈরি কলা গাছের শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। গ্রামে যে ফুল পাওয়া সেই ফুল দিয়েই শহিদ বেদীতে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। আবার অনেকেই শহর থেকে ফুল আনিয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজনের) সহ-সভাপতি বাদল মাহমুদ জানান, নিঃসন্দেহে এটি একটি ভাল দিক। অন্ততপক্ষে প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা বুঝতে পারছে একুশে ফেব্রুয়ারিতে একটা কিছু হয়েছে। সেজন্য গ্রামের কোমলমতি শিশুরা কলা গাছ দিয়ে শহিদ মিনার তৈরি করে বড়দের অনুকরণে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে- খালি পায়ে প্রভাত ফেরি করেছে। এটা নিঃসন্দেহে ভাল দিক।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker