১৯৯৫ সনের ১৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুর ইন্তেকাল করেন। আজকের এই দিনটি জহুরুল ইসলামের প্রয়াণ দিবস। বাঙ্গালী জাতির এক আলোকোজ্জ্বল নক্ষত্রের বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া অদ্যকার দিনটি। বাঙ্গালী ও বাংলার ইতিহাসে অনন্তকাল অমর হয়ে থাকা ব্যাক্তিটি জহুরুল ইসলাম।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়- কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর থানার ভাগলপুর একটি ঐতিহ্যবাহী বর্ধিষ্ণু গ্রাম, এই গ্রামেরই এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালের ১লা আগষ্ট রোজ বুধবার জহরুল ইসলাম জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আলহাজ্ব আফতাব উদ্দিন আহম্মদ এবং মাতা রহিমা আক্তার খাতুন। তার পিতা ছিলেন, কিশোরগঞ্জ জেলার একজন পরিচিত ব্যাক্তিত্ব তিনি ১৯৫৮ -১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বাজিতপুর পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। অত্র এলাকার জনহিতকর কর্মকান্ডে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য ।
জহরুল ইসলাম স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল থেকে ৫ম শ্রেণী শেষ করে কিছুদিন সরারচর শিবনাথ হাইস্কুল অধ্যয়ন করেন তারপর বাজিতপুর হাই স্কুলে উচ্চতর শ্রেনীতে লেখাপড়া চলা কালীন চাচা মহকুমা প্রকৌশলী মুর্শিদ উদ্দিনের সাথে কলকাতায় চলে যান। সেখানে ইংরেজী মাধ্যমে কলকাতা রিপন হাই স্কুল থেকে মেট্টিকুলেশন পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্ধ্মান জেলার এক কলেজে আইএ ভর্তি হন। সেখান থেকে ও পরিস্থিতির চাপে চলে এসে কিছুদিন মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে অধ্যয়ন করেন।
আরো জানা যায়- প্রতিকুল পরিবেশ ও পরিবারিক দায়-দায়িত্বের চাপে তিনি আর লেখা-পড়ায় এগুতে পারেননি। সেই জন্যই হয়তো শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি ছিলে আজীবন মুক্ত হস্ত। কোন প্রতিকুলতায় তাকে জীবন সংগ্রামে দমাতে পারেনি।
জানা যায়- ১৯৪৮ সালে মাত্র ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সিএন্ডবি এর ওয়ার্ক এসিস্টেন্ট এর চাকুরীতে নিযুক্ত হন। তিন বছর পর ১৯৫১ সালে চাকুরীতে ইস্তফা দেন। তারপর তিনি ঠিকাদারী কাজে নিজেকে যুক্ত করেন প্রথম ঠিকাদার হিসাবে তিনি এক সরকারী অফিসে ১২ শত টাকার ষ্টেশনারী সরবরাহ করেন। তারপর তিনি কিশোরগঞ্জে পোষ্ট অফিস নির্মাণ এবং তার পরবর্তীতে গুলিস্থান থেকে টিকাটুলী সড়কের ঠিকাদারী পান। এর পর থেকে তাকে আর পিছু ফিরতে হয়নি। মাত্র ২ বছরের মাথায় নিজেকে তিনি একজন ১ম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কঠিন অধ্যবসায় কিনা পারে? জহুরুল ইসলামই তার জ্বলন্ত উপমা।
আর্থিক অবস্থা পরিবর্তন হবার সাথে সাথে তিনি পিতার ১৩ সদস্যের পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং ১৩ সদস্যের একান্নবর্তী পরিবার এক সময় বিশাল এক পরিবারে রুপ নেয়। যা তিনি ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন ।
১৯৫৬ সালে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার স্বনামধন্য পরিবারে অধ্যাপক মোশাহেদ আলী চৌধুরী সাহেবের কন্যা সুরাইয়া বেগমের সাথে তিনি বৈবাহিক বাধনে আবদ্ধ হোন।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর লেখা, ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে, জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ জুন ঢাকা ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি ‘সুবেদ আলী’ ছদ্ম নাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোটা অংকের নগদ আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খানের লেখা ‘স্বৈরাচারের দশ বছর’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, জহুরুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তান সরকারের জেলে আটক নেতাকর্মীদের মোকদ্দমাদির খরচ, আহতদের চিকিৎসার খরচ এবং ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার খরচ ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন। এভাবে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন মুক্তি আন্দোলনে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন মহান মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি ছিলেন একজন ক্রীড়া মোদী ও মোহামেডান ক্লাবের সদস্য। তিনি নাভানা ক্রিকেট লীগের প্রবর্তক।
১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকাসহ সারা দেশে দুইশ লঙ্গরখানা স্থাপন করেন। এর মাঝে কিশোরগঞ্জ আখড়া বাজারেও একটি ছিল।
তিনি ছিলেন দানবীর গরিবের মাঝে তিনি অকাতরে দান করেছেন। তিনি বহু কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা এবং ঋনগ্রস্থদের আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাদেরকে মুশকিল থেকে উদ্ধার করেছেন।
জহুরুল ইসলাম ছিলেন এদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি এক অসাধারণ বাঙালি কৃতী সন্তান, যার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। তার মহত্ত্ব, কৃতিত্ব ও আদর্শ তথা দেশপ্রেম বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য পাথেয় এবং অমর হয়ে থাকবে। আজ উনার প্রয়াণ দিবসে, লাখো মানুষের প্রাণে জেগেছে কোমলন্তর ঢেউ, তার আত্মার শান্তি কামনা, প্রার্থনায় ন্যাস্ত সকল শ্রেনী পেশার মানুষ।