কিশোরগঞ্জ

প্রকৃতির রাণী হাওর কণ্যা কিশোরগঞ্জ

মাহফুজ রাজা, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি:

মাটির উপরে জলের বসতি জলের উপরে ঢেউ, তরঙ্গের সাথে পবনের পিরিতি নগরের জানে না কেউ। এ পঙক্তির পূর্ণ প্রকাশ কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলেই যেন খুঁটি গেড়েছে। জলবায়ুর দুটি রূপ—স্বপ্নীল ও ভয়াল। আবহাওয়ারও দুটি ধরন—নিরাগ (শান্ত) ও আফাল (তুফান)। যা একেক সময় একেক রূপে আবির্ভুত হয়।

নিকলী, ইটনা, মিঠাইন ও অস্ট্রগ্রাম উপজেলার নৈসর্গিক হাওরের রূপবৈচিত্র্য পর্যটনে ও বিনোদনে গৌণ-গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমের কল্যাণে বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে স্বপ্নীল রূপে। বিশেষ করে কিশোরগঞ্জের হাওর। বলা হচ্ছে বর্ষায় অস্ট্রেলিয়া, শুকনায় নিউজিল্যান্ড। আসলে হাওর তার চেয়েও বেশি। সুন্দরে সুন্দরে পাল্লা।মন মৌনতার অবসানের মাধ্যম হাওর প্রকৃতি অবলোকন।

হাওরের রূপ-সৌষ্ঠব-মাধুর্য স্বচক্ষে না দেখলে উপলব্ধিতেও আসবে না প্রকৃতির ঐশ্বর্য।

ছয় ঋতুর দেশ হলেও হাওরে মৌসুম দুটি—বর্ষা ও শুকনা। বর্ষা মৌসুমকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘বাইসা মাস’ বা ‘অদিন’ এবং শুকনা মৌসুমকে বলা হয় ‘সুদিন’। এই ‘অদিন-সুদিন’ মিলে বারো মাস। বর্ষায় দিগন্তজোড়া অথৈ গভীর জলরাশি এবং শুকনায় মাঠজোড়া সোনালি ফসল আর সবুজ চারণভূমি। আরও রয়েছে পানির নিচে সর্পিল ডুবু সড়ক আর পানির উপরে নান্দনিক আডুবা সড়ক।

শনিবার মিঠাইন হাওরে গিয়ে দেখা যায়, সবুজের বনানী আবার তার বুক ছিরে দিগন্তে ছুটে চলা সড়কগুলি মন ভাসিয়ে নিয়ে যায় কল্প রাজ্যে।নদীতে পানির স্বল্পতা ঘাটে বাঁধা নৌকা। 

হাওরাঞ্চলের নয়নাভিরাম দৃশ্য ঋতুভেদে রূপ বদলায়। শুকনা মৌসুমে হাওরের আঁধার কেটে ‘সুদিন’র প্রত্যাশায় সূর্য উদিত হয় মাটি ফোঁড়ে ওঠা সোনালি রোদের আলোকচ্ছটায়। চারিদিকে দিগন্তবিস্তৃত সবুজে, কখনোবা সোনালি ফসলি মাঠ নেচে ওঠে নৈঋতী হাওয়ায়। 

পূর্ণিমার রাতে বিলের ফুটন্ত শাপলা ফুল ভাব জমায় চাঁদের সাথে। শরৎ-হেমন্তে মুখরিত সাইবেরীয় অতিথি পাখির কলতানে। মালার মতো দলবেঁধে দৃষ্টিসীমায় উড়ে চলে বলাকার ঝাঁক। বৈশাখ মাসে পাকা সোনালি ধান ঘরে তোলার অকুণ্ঠ উচ্ছ্বাসে কৃষাণ-কৃষাণীর কণ্ঠে কতই না স্বপ্নবোনা গীত। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে জোনাকি ও ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে শস্য-শ্যামল ফসলি মাঠের মাঝ দিয়ে হাওরের বুক চিড়ে তৈরি কিশোরগঞ্জের হাওরে ৪০ কিলোমিটার সাবমার্সিবল রোড বা ডুবু সড়কে ফুরফুরে শীতল হাওয়ায় মোটর বাইক বা গাড়ি হাকিয়ে বেড়ানো মনমোহিনী পুরীর দেশে বিচরণের শিহরণ জাগে অন্তরে অন্তরে।

বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতি ফিরে পায় ভরা যৌবন। হাওর রূপ নেয় নীল দরিয়ার কলতানে। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। এসময় মূলত অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিস্টদের পদচারণায় হাওর হয়ে ওঠে সরগরম। থৈ থৈ জলে রুপালি মাছের খেলা। মাথার উপর কিচিরমিচির মৃদুল শব্দে পাখপাখালির দল। নীল ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে মেঘের পালক ও শুভ্র মেঘের বিনুনি। কোথাও কোথাও ছায়া হয়ে করচ হিজল বনের সবুজ বেষ্টনির দ্যুতিময়তা। মেঘছায়া আকাশে দক্ষিণা হিম উদাসীন হাওয়া শনশন শব্দে পরশ বুলিয়ে ছুটে চলে হিমালয় পানে তার প্রিয়তমা মালতির দেশে। দিনের ঝলমল আলোয় কাকের চোখের ন্যায় কালো স্বচ্ছ জলরাশির মাঝে ডুবুডুবু ভাসমান দূরের বিচ্ছিন্ন সবুজ ছাতায় আচ্ছাদিত গ্রামগুলো দেখতে ‘আন্দামান দ্বীপ’র মতোই ঠিক যেন জলেভাসা পদ্ম। অরুণ আলোর প্রভায় গভীর জলরাশিতে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তে সুনীল অসীম আকাশের সাথে দিগন্তজোড়া হাওরজলের মিতালি। 

নির্মল মুক্ত বাতাসে ‘মনপবনের নাওয়ে’ চড়ে স্রোতে অনুকূলে ভেসে বেড়ানো এবং স্পিডবোট ও রঙিলা ট্রলার চেপে দুরন্ত ছোটাছুটি আর টইটুম্বুর তরঙ্গজলে উচ্ছ্বসিত দাপাদাপি-জলকেলির রোমাঞ্চে স্বর্গীয় অনুভূতিতে স্বপ্নপুরীর মায়াবী হাতছানি প্রকৃতিপ্রেমি ও পর্যটকদের পাগলপারা করে তুলেছে। 

শহুর জীবনের জৌলুসের গল্প গ্রামীণ জীবনে অবসর বিনোদনের অঙ্গ ছিল। এখন সেই শহুরেরা জৌলুস ছেড়ে সুর তুলছে, ‘হাওরদেশে আইস্যা আমার আশা ফুরাইছে…।

শুধু কি তা-ই! মেঘমালায় হাতির শুর দিয়ে আসমানে হাওরের পানি তুলে নেওয়ার দৃশ্য এবং হাওরজলে উদিত রংধনুর ‘নয়ন জোড়ানো’ অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য দেখার অফুরান দুর্নিবার ব্যাকুলতা।প্রকৃতির রাণী হাওরাঞ্চল যেন মন সুখের ঔষধ বহন করে চলে।

কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ বলেন, ‘হাওরে যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে কেউ আসতে চাইত না। এখন প্রচুর পর্যটক হাওরে আসেন। পর্যটকদের আগমন দেখে আমারও ভালো লাগে।হাওর ঘিরে আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন,সেগুলো বাস্তবায়ন হলে পর্যটকদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গায় পরিণত হবে আমাদের এলাকা।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker