কিশোরগঞ্জ

হাতের লেখা চিঠি এখন স্মৃতির জাদুঘর

মাহফুজ হাসান:
“চিঠি লিখেছে বউ আমার  ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাতে”
বিখ্যাত এ গানের অন্তরার সাথে বাস্তবে বর্তমানে মিল খুঁজে পাওয়াটা আকাশ কুসুম কল্পনার মতোই। 
রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে। রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে, রানার রানার চলেছে, রানার’- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের সেই রানার আজ নেই। ডাক বিভাগে লেগেছে অধুনিকতার ছোঁয়া। তবে এত কিছুর পরও দিন দিন কমেছে চিঠি। গত ৫ বছরে ডাক বিভাগের চিঠি কমেছে অর্ধেক। শুধুমাত্র সরকারি কাজে ও অফিসিয়িাল ছাড়া ডাক বিভাগে আর ব্যক্তিগত চিঠি আসে না। যদিও বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তবে কমেছে চিঠি।
১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস,দিবস আছে কিন্তু দিবসের প্রাণ নেই,নেই তেমন মানুষের কাছে পরিচিতি দিনটি।সে সময়টা থাকলে হয়তো এই দিবসটি আলোচিত থাকতো যে সময়টায় হৃদয় নিংড়ানো মায়া,মোহাব্বত কিম্বা আবেগ বন্দি ছিল খামের ভেতর।চিঠির খামই যেন সকল ভালোবাসা বয়ে বেড়াতো। 
আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার এই দিকে ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধনে অদ্ভুত সুললিত সব চিঠি লিখতেন প্রিয় সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীকে। সুকান্তের প্রতিবাদী চেতনাভরা চিঠির সংকলন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের চরম অর্থনৈতিক সংকটকালে বিদ্যাসাগরকে লেখা চিঠিগুলো, রবীন্দ্রসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের গায়কি নিয়ে বিশ্বভারতীর বিমাতাসুলভ আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর লেখা সব দাপ্তরিক ও অসম্ভব অভিমানী সব চিঠি—এই সবই আমাদের মনোজগতে প্রবল অনুরণন তোলে।
মহাত্মা গান্ধী, আলবার্ট আইনস্টাইন, জওহরলাল নেহরু এমনকি হিটলার, মুসোলিনির চিঠিগুলো আজও আমাদের ইতিহাসের পাঠ দেয়। তবে শুধু গুরুগম্ভীর চিঠি নয়, প্রিয়জনের কাছে লেখা নেপোলিয়ন, রাজা হেনরি, সুরস্রষ্টা বিটোভেন, শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর লেখা বিখ্যাত প্রেমপত্রগুলো তাঁদের প্রেমময় অনুভূতির এক অনন্য প্রকাশ। কিংবা ভাই থিওকে লেখা শিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের চিঠিগুলো। আহা কত কী যে রয়েছে লেখা আখরে আখরে!
যুগে যুগে চিঠির ভাষার সাহিত্যমূল্য কিন্তু আমাদের অবাক করেছে, করেছে মুগ্ধ। চিঠির আদলে লেখা রবিঠাকুরের গল্প স্ত্রীর পত্র, কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধনহারার মতো পত্রোপন্যাস তো বটেই, বিভিন্ন সময়ে লেখা জীবননিষ্ঠ চিঠিতে একেকটি সময়ের আখ্যান লেখা থাকে। অশভিচে জার্মান কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে ইহুদি বন্দীদের লেখা চিঠির সংকলন নিয়ে লেখা বইগুলো আজও সাক্ষ্য বহন করছে সেই দুঃসহ সময়ের। নেলসন ম্যান্ডেলা আর আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দেশের জন্য কারাবরণের সময়ে লেখা চিঠিগুলো যেন একেকটি প্রামাণ্য ঐতিহাসিক দলিল।
 ১ সেপ্টেম্বর। দিনটি আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস হিসেবে স্বীকৃত। বহু আগে ইংরেজ কথাকার সমারসেট মম যা বলেছিলেন, বর্তমানের বাস্তবতায় সেটাই সত্যি। চিঠি লেখা আসলেই এক হারিয়ে যাওয়া শিল্প। ‘ভাল আছি ভাল থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’, এই গানের বোল বাঁধতে গিয়ে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কি কোনো দিন ভেবেছিলেন যে মানুষ একসময় শুধুই আকাশের ঠিকানায় অর্থাৎ অন্তর্জালে (ই-মেইলে) চিঠি লিখবে! শেরশাহের ঘোড়ার ডাক প্রচলনের আগে কীভাবে চিঠি আদান-প্রদান হতো, তা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও আজকাল দাপ্তরিক কাজের নথি বা আবেদনপত্রের ঝক্কি ছাড়া কেউ ডাকঘরে যে আর যায় না, সে সবারই জানা। অথচ একসময়ে দূরে থাকা আপনজনের সঙ্গে যোগাযোগের একটি মাধ্যমই ছিল চিঠি। শুধু দূরে নয়, অন্তরের খুব কাছের কাউকে মুখে না বলতে পারা কথাগুলোও সযত্নে সাজিয়ে নেওয়া হতো চিঠিতে। এক একটি চিঠিতে কত যে গল্প, কত যে ইতিহাস থাকত! আর থাকত টইটম্বুর আবেগ।চিঠি খোলাও ছিল অনাবিল আনন্দের প্রিয়জনের লেখা চিঠিগুলি একবার খুলে বারবার পড়তে মন চাইতো।যা এখন আর  তথ্য প্রযুক্তির কালে হয়না।
প্রবাসী সন্তানের চিঠির পথ চেয়ে বসে থাকতেন মা। কখনোবা নীল খামে ভরা চিঠির ভাঁজে সুগন্ধি মাখিয়ে বা গোলাপের পাপড়ি গুঁজে ভালোবাসার বার্তা যেত প্রিয় মানুষটির কাছে। এখনো অতীতবিলাসী বহু মানুষের কাছে সযত্নে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেওয়া আছে গুচ্ছের সব চিঠি। হয়তো যিনি লিখেছেন, সেই মানুষ আর নেই, তবু চিঠিতে রয়ে গেছে তাঁর আবেগময় কথাগুলো।
ঠিক এই মুহূর্তে মনে পড়ছে বিখ্যাত ইংরেজ লেখক সমারসেট মমের কথা। সেই কবে তিনি একটা ছোটগল্প লিখেছিলেন, যার শিরোনামই ছিল ‘দ্য লেটার’। সেখানে একটা লাইন ছিল: লেটার রাইটিং ইজ আ লস্ট আর্ট। সেই কবে গত শতকের প্রথম ভাগে লেখা এই গল্পে এমন রূঢ় সত্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। সেটাই আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বিশেষ করে আমরা যারা চিঠি লিখে, চিঠি পড়ে বড় হওয়া প্রজন্ম। ডাকপিয়নের জন্য অপেক্ষায় থাকা প্রজন্ম। এমনকি দুপুরে খাওয়ার পর পান খেতে খেতে মা-চাচিদের জমিয়ে আড্ডার ফাঁকে চিঠি পড়া আর খুনসুটিতে মেতে ওঠার দেখে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম।
প্রযুক্তি সভ্যতারই ধারক ও বাহক। তবু চিঠির মতো এত বিশেষ আর অসামান্য একটি ধারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর মুঠোফোনের খুদে বার্তার ভিড়ে হারিয়ে গেছে, এ কথা ভাবলেও হৃদয়ের কোথায় যেন এক রক্তক্ষরণ হয়। তবে এই প্রসঙ্গে আরও একটা বিষয়ের অবতারণা মন্দ হবে না বোধ করি। আমাদের দেশে ইন্টারনেট জমানা শুরুর দিকে ই–মেইল চালু হওয়ার পর অনেক মা–বাবাকেই দেখেছি রোমান হরফে কষ্ট করে বাংলা উচ্চারণে চিঠি লিখেছেন পরিযায়ী আত্মজাদের। সেসব অক্ষরেও ছিল অনিঃশেষ মমতায় মাখামাখি।
আজকের এই ডিজিটাল জমানায় এমন একটা চিঠি পুরনো দিনের মানুষটিকে উদ্বেল করবে বৈকি! হয়ে উঠবেন স্মৃতিকাতর। হয়ত মনে পড়ে যাবে তাদের যৌবনের প্রিয় সেই গান, বনশ্রী সেনগুপ্তের গাওয়া: আজ বিকেলের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম/রঙিন খামে যত্নে লেখা আমারই নাম।
বাবাকে হয়তো কোনো দিন বলা হয়নি কতটা ভালোবাসি তাঁকে, মাকে হয়তো বলা হয়নি যে সব সময় আমি পাশে আছি আর তিনি যেন তাঁর নিজের যত্ন নেন একটু।কিন্তু দূর প্রবাস থেকে খুব সহজে দরদ দিয়ে লেখা হতো।
হয়তো ১৫-২০ বছরের দাম্পত্য জীবন কেটে গেছে, এখন আর বলা হয় না কোন রঙে তাকে খুব মানায়, অথবা সে হাসলে ঠিক কেমন অনুভূতি হয়। হয়তো কোনো এক সামান্য কারণে খুব প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কেমন যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, কিন্তু বহুদিন কেটে গেছে বলে ফোনটা আর করা হয় না। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বন্ধু তালিকাতে নিশ্চুপ উপস্থিতিটুকুই আছে। সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে লিখেই ফেলা যাক চিঠিটা। হৃদয় নিংড়ানো, হাতে লেখা চিঠিটা পেলে প্রিয় মানুষটির মন ভালো হয়ে যেতে বাধ্য। আর আজকের এই চিঠি দিবসের সার্থকতা কিন্তু সেখানেই।
চিঠি! এ বিষয়টির সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে নানা স্মৃতি, নানা আবেগ। একসময় যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল চিঠি।
 মোবাইল ফোন ও ই-মেইলের যুগ আসার আগে চিঠির কদর ছিল সর্বত্র। চিঠি লেখার আবেগ বর্তমানের ম্যাসেঞ্জারের টেক্সট কিংবা মেইলে পাওয়া যায় না। আগে একেকটি চিঠি যেন হয়ে উঠত একেকজনের জীবনে প্রাণের সঞ্চার।
শুধু প্রেম নয়, সব ধরনের যোগাযোগ হতো চিঠির মাধ্যমে। কোনো এক বেকারের চাকরির খবর, বিদেশে থাকা ছেলের মায়ের কাছে চিঠি কিংবা দেশ হতে বিদেশে ছেলের জন্য মায়ের লেখা চিঠি। কোনো এক মৃত্যুর চিঠি আবার সারা পরিবারে বয়ে আনত স্থবিরতা। শুধু দূরে কিংবা অদেখা মানুষকেই মানুষ চিঠি লিখত না, যার সাথে প্রায়ই দেখা হয় কিংবা প্রতিদিন দেখা করা প্রেমিক প্রেমিকাও একে অপরকে চিঠি লিখত। কারণ, চিঠিতে যত সুন্দর ভাষায় মনের অনুভূতি গুছিয়ে প্রকাশ করা যায়, মুখে ততটা বলা হয়ে ওঠে না৷ শুভেচ্ছা বার্তা, খোঁজ-খবর নেওয়া, টাকা পাঠানো, চাকরির যোগদানপত্র সবই এক সময় আসত চিঠির মাধ্যমে। আগের মতো আর বাড়িগুলোর গেটে দেখা মেলে না চিঠির বাক্সের। প্রেয়সীর কাছে সুগন্ধী মেখে চিঠি লিখত প্রেমিক, এমন কথা অনেকেই হয়ত শুনেছেন। এসব বানোয়াট কোনো গল্প নয়, একেবারেই সত্যি।
আমাদের মনে পড়ার আরও কারণ অবশ্যই আছে স্কুলে বাধ্যতামূলক চিঠি লেখা শেখানো হতো। এখনো হয় অবশ্য। এমনকি মেইল লেখাও শেখানো হয়। তবে আমাদের সময়কার আবেগ এই জেড বা মিলেনিয়াল জেনারেশনের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। এমনকি এনভেলপ দেখলেও পোস্টকার্ড, ইনল্যান্ড রেটার কি তা তারা জানেও না, দেখেওনি হয়ত।
এখনো হয়তো ঘরের কোনো দেরাজে বা আলমারির ওপরে কোনো বাক্সে রাখা আছে আমাদের বাবা, মা, মাতামহী, পিতামহের লেখা স্নেহময় চিঠি। কোনো এক অজানা কোনায় খুঁজে দেখলে লাল ফিতায় বাঁধা নীল খামের চোখ ভেজানো চিঠিগুলো পেলেও পাওয়া যেতে পারে বর্ষীয়ান কারও বাড়িতে। আজকের এই অস্থির সময়ে আমরা চিঠি লিখতে ভুলে গেছি। চিঠি শুধু এখন ইতিহাসের পাতায়, গল্পে উপন্যাসে আর কবিতার উপমায়। কারণ, এখন ই–মেইলও যথেষ্ট কেজো। সেখানে খুব দরকারি কথা ছাড়া কিছুই বলতে গেলে থাকে না। তার ওপর রয়েছে টেক্সট মেসেজ বা খুদে বার্তা।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker