কিশোরগঞ্জ

খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি

মাহফুজ হাসান,কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি:
“আগে ছিলো খড়ম,মানুষের ছিলো শরম”
ময়মুরুব্বিদের মুখে আঞ্চলিক এ প্রবাদটি প্রায়শঃই শোনা যায়। খড়ম নিয়ে এই লোকজ ছড়াটিও জনপ্রিয়, 
হরম বিবি খড়ম পায়,
খটটাইয়া হাঁইটা যায়।
হাঁটতে গিয়া হরম বিবি
ধুম্মুড় কইরা আছাড় খায়।
আছাড় খাইয়া হরম বিবি
ফিরা ফিরা পিছন চায় ….
খড়ম হলো কাঠ দিয়ে তৈরি পাদুকা যা কালের গহবরের বিলিন হয়ে যাচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলায় অনেকেই ব্যবহার করতেন খড়ম। বাংলাদেশে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন।  ভারত উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহজালাল (র:)১৪শ শতকে বাংলাদেশের সিলেটে বসতি স্থাপন করেছিলে। তার ব্যবহৃত খরম এখনো তার সমাধিস্থল সংলগ্ন স্থাপনায় সংরক্ষিত আছে।
Image
জানতে পারি,সনাতন ধর্মে খড়মের ব্যবহার অনেক প্রাচীন, তারা খড়মকে দেবতা ও শ্রদ্ধেয় সাধুসন্তদের পদচিহ্নের প্রতীকও মনে করেন অনেকে। সনাতন ধর্মের পাশাপাশি জৈনধর্মেও  ভিক্ষাজীবি সন্ন্যাসী ও সাধুসন্তেরা খড়ম ব্যবহার করতেন। সনাতন ধর্মের মহাকাব্য রামায়ণে খড়মের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এক সময় সমগ্র  দেশের মানুষই নির্ভরশীল ছিলো ঐ কাষ্ঠ পাদুকা (খড়ম) এর  উপর।
কিছুকাল আগেও খড়মের শব্দে গৃহস্থরা বুঝতে পারতেন তাদের বাড়িতে কেউ আসছেন। ৬০-৭০ দশকে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় খরমের  ব্যবহার ছিলো চোখে পড়ার মতো বয়োজ্যেষ্ঠদের অভিমত।
জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জামাল উদ্দিন (৮০) জানান, আগে  বাড়ীতে আত্নীয় বা কুটুম আসলে একজোড়া খরম আর এক ঘটি পিতলের এক নোটা পানি দিতাম হাত ও মুখ ধৌত করার জন্য।তিনি আরও জানান যে,আগে এই খড়ম পরে বিবাহ হত । এই খড়ম পায়ে দিয়েই নববধূ তার শশুর বাড়ীতে যেত।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় কাঠের তৈরি  খড়ম এখন শুধুই স্মৃতি। কালের বিবর্তনে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কাষ্ঠ পাদুকা খড়ম। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
জানা যায়, চামড়া , রেকসিন, প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি দিয়ে তৈরি জুতা এখন মানুষের পায়ে শোভা বর্ধন করে।বিগত কয়েক বছর ধরে বার্মিস জুতায় ছেঁয়ে গেছে বাংলাদেশের নগর-মহানগর, শহর- এমনকি গ্রাম বাংলার মানুষের পায়ে পায়ে।
হোসেনপুর উপজেলার কাঠমিস্ত্রি লাহু মিয়া জানান যে, কাঠ দিয়ে তৈরি খড়ম পরিবেশবান্ধব। একখন্ড কাঠ পায়ের মাপে কেটে নিয়ে খড়ম তৈরি করা হয়। খড়মের সম্মুখভাগে একটি বর্তলাকার কাঠের গুটি বসিয়ে দেওয়া হয়, যা পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও পাশের আঙ্গুলি দিয়ে আকড়ে ধরা হয়।
কটিয়াদি উপজেলার সাংবাদিক মাসুদুল ইসলাম সবুজ  জানান, ৭০ এর দশক পর্যন্তও জনপ্রিয়   ছিল খড়ম। তবে, সে সময় পশুর চামড়ায় তৈরি জুতাও কম-বেশি ছিল। পরে যানবাহনের চাকায় ব্যবহৃত টায়ার ও টিউব কেটে তৈরি হয় এক ধরনের জুতা। যার নামকরণ করা হয় টায়ার জুতা। কালের বিবর্তনে  ঐ টায়ার জুতাটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়।
এর পর আসে সেন্ডেল। বর্তমানে বিভিন্ন মডেলের সেন্ডেলে বাজার সয়লাব।
বাজিতপুর উপজেলার বয়োবৃদ্ধ মিহির লাল ঋশি জানান, একটি কাষ্ঠ পাদুকা খড়ম তৈরি করতে (মজুরি ও কাঠের দাম বাবদ) বর্তমান বাজারে খরচ পড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। পক্ষান্তরে বার্মিসের একটি পাদুকা পাওয়া যায় মাত্র ৮০ থেকে ১০০ টাকায়।দামসাশ্রয়ী হওয়ায় সবাই বার্মিসের জুতাই ব্যবহার করেন।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মনিরুজ্জামান জানান, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও বার্মিস জুতা ব্যবহার করতে হচ্ছে। খড়ম পায়ে দিয়ে চলাফেরা করলে বেমানান মনে হয়, বিধায় ইচ্ছা থাকলেও আর খড়ম ব্যবহার করি না। তবে, এখনও খড়ম পায়ে দিয়ে চলাফেরা করেন এমন মানুষও কম-বেশি রয়েছে । মূলত তারাই ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খড়ম।
ব্যবহারকারী কমে যাওয়ায় পরিবেশবান্ধব কাষ্ঠ পাদুকা বিলুপ্তপ্রায়। খড়ম শিল্পের সাথে জড়িত কারিগররাও কমে যাচ্ছেন।এভাবে কালের বির্বতনে হারিয়ে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জ জেলা থেকে ঐতিহ্যবাহী কাষ্ঠ পাদুকা (কাঠের তৈরি খড়ম ।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker