কিশোরগঞ্জ

প্রেমে জীবন উৎসর্গ করা পাখি ‘ডাহুক’ আজ বিপন্নের পথে।

মাহফুজ হাসান,কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি:
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে এখন বিপন্ন তালিকায় ডাহুক পাখি। মাঝারি আকৃতির জলের পাখি ডাহুক। ডাহুক খুব সতর্ক পাখি। আত্মগোপনে পারদর্শী। এই পাখিটি খুব ভীরু বলেই কি এত সুন্দর? ভালোবাসার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও বলা যায় ডাহুক কে। প্রাণী কূলের গভীরতম প্রেমাবেগের জুটির নাম ডাহুক -ডাহুকী। কবিকুল তাকে ভালোবাসার নিঃস্বার্থ প্রহেলিকা বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। কবি জীবনানন্দ দাস এই ডাহুক পাখি নিয়ে লিখেছেন, “মালঞ্চে পুষ্পিতা অবনতামুখী,নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী।বিজন-তরুণ শাখে ডাকে ধীরে ধীরে বনচ্ছায়া- অন্তরালে তরল তিমিরে”। কবি আল মাহমুদের কবিতাতেও এই বর্ণিল পাখির কাব্যময় উপস্থিতি রয়েছে।হায় আফসোস! অনেকটা নগরায়নের ফলে দিনকে দিন বিলিন হয়ে যাচ্ছে এ পাখি।
উপজেলার গলাচিপা গ্রামের পাখি প্রেমী শাহ আলম বলেন,আসলে পাখিটি চিরবিরহী প্রকৃতির। জলচর ডাহুক-ডাহুকির ভালোবাসার গল্প অনেকটা আরব্য উপন্যাসের লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, রজকিনী-দন্ডিদাস, আনারকলি- সেলিম কিম্বা দেবদাস-পার্বতীর মতোই। বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো এই ডাহুক- ডাহুকী শাশ্বত পলিটনিক (দেহাতীত) ভালোবাসার প্রতীক। সঙ্গীহীন হলে এরা পাগল হয়ে যায়। ডাহুক হারালে ডাহুকী দিনরাত ডাকতে ডাকতে গলা চিরে রক্ত উঠে এক সময় মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়ে। সঙ্গী ছাড়া এক মুহূর্ত নয়। কি অবাক ও মর্মান্তিক পাখি ডাহুক! তাই বুঝি বিদ্যাপতি, চন্ডিদাস, ফররুখ আহম্মেদ, জীবনানন্দ, আল মাহমুদের কবিতার অলংকার হয়েছে ডাহুক পাখি।
যুগ যুগ ধরে হোসেনপুরের নদ-নদী, খাল, বিল-ঝিল, ডোবা, নালা-দীঘির পাশের ঝোপঝাড়ে দল বেঁধে একত্রে বাস করতো ডাহুক পাখি। কিন্তু এখন খুঁজে পাওয়াটা দুষ্কর। 
হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ বলেন, ডাহুক অনেকটা বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে দেখা যায়। ঝোপঝাড় ধ্বংসের ফলে ডাহুকের বর্তমান অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। প্রকৃতিতে এদের নিরাপত্তা দিতে অবশ্যই এদের বাসস্থান ধ্বংস বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন বিপন্নের লাল তালিকায় লেখা হবে ডাহুক পাখির নাম।
এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান রৌশনারা রুনু বলেন,গ্রামাঞ্চলের পুকুর ও নদীর পাড়ের কিংবা ঝোপঝাড়ে সন্ধ্যেবেলা ডাহুকের ডাক শোনা যেত। গভীর রাতেও ডাহুকের ডাকে অনেকের ঘুম ভাঙতো। তবে আজকাল আর ডাহুকের কণ্ঠ শোনা যায় না। একসময় বর্ষা ও শরতে ডাহুকরা বাড়ির গৃহপালিত হাঁস মুরগির সঙ্গে বেড়াতো। এখন আর তাদের আনাগোনা দেখা যায় না। চোখে পড়ে না। ডাহুক পাখি এখন হারিয়ে যেতে শুরু করেছে।
জানা যায়-  বর্ষাকাল এদের প্রজনন ঋতু। এসময় তারা পানির কাছেই ঝোপঝাড়ের ভেতরে অথবা ছোট গাছের ঝোপযুক্ত ডালে বাসা করে। নিরাপত্তা ঠিকঠাক থাকলে মাটিতেও বাসা করে এই পাখি। ৫-৭টি ডিম পাড়ে এরা, ডিমের রং ফিঁকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডাহুক-ডাহুকি দু’জন মিলেই ডিমে তা দেয়। বাচ্চার রং সব সময় হয় কালো। ডিম ফোটে প্রায় ২১-২৪ দিনে। আর ২৪-৩০ ঘণ্টা পরই বাচ্চারা বাসা ছাড়ে। মাস তিনেক পরে বাচ্চারা আলাদা জীবন বেছে নেয়। প্রজননের সময় একটি পুরুষ ডাহুক অন্য একটি পুরুষ ডাহুককে সহ্য করতে পারে না। দেখলেই তারা মারামারি করে। এই পাখি লড়াকু প্রকৃতিরও।
হোসেনপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো. উজ্জ্বল হোসাইন বলেন,
ডাহুকের প্রিয় খাদ্য জলজ পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ। এছাড়াও শাপলা-পদ্ম ফুলের নরম অংশ, কচি পানিফল, জলজ শেওলা, লতাগুল্মের নরম অংশ, ধান, কাউন, ডাল, সরিষা, শামুক, কেঁচো, জোঁক, মাছ, ছোট মাছ, শাকসবজি ও ফল খেয়ে থাকে। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।বর্তমানে তাদের আবাস্থল ধ্বংস হচ্ছে। খাদ্য সংকট ও প্রজননকালীন সময়ে শিকারীদের উৎপাতসহ নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব এ প্রজাতির পাখি। শিকারিদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাচ্ছে না গভীর বনজঙ্গলে বসবাসকারী ডাহুক পাখি গুলো। প্রকৃতিকে সুন্দর রাখতে পাখ-পাখালিকে নিরাপত্তা দিতে হবে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker