কিশোরগঞ্জকৃষি ও পরিবেশ

কৃষ্ণচূড়ার রঙে বর্ণিল প্রকৃতি সেজেছে বধুয়া সাজে

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ প্রতিটা ঋতু দেশীয় প্রকৃতিকে ভিন্ন লুকে উপস্থাপন করে। প্রকৃতিতে এখন গ্রীষ্মকাল। এ ঋতুতে কখনো কালবৈশাখীর রুদ্র তাণ্ডব, কখনো রোদের খরতাপ। কখনো আবার মোখা, মোচা এমন অদ্ভুত নামে প্রকৃতির সাথে কুস্তি লড়তে ব্যস্ত কাল বৈশাখী, তবে মন জুড়াতে এ সময় ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। তপ্ত গ্রীষ্মে ডানা মেলা রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া পথের ধারে নীরবে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় বেরোলেই ফুলভর্তি এ রকম কৃষ্ণচূড়া গাছের দেখা মিলছে। কোথাও এক বা একাধিক গাছ কোথাও সারি সারি অসংখ্য গাছে শোভা পাচ্ছে কৃষ্ণচূড়ার রঙিন ফুল। কিশোরগঞ্জের প্রকৃতি এখন কৃষ্ণচূড়ার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে।

কৃষ্ণচূড়া গ্রীষ্মের অতি পরিচিত ফুল। বাঙালির কবিতা, সাহিত্য, গান ও বিভিন্ন উপমায় কৃষ্ণচূড়া ফুলের কথা নানা ভঙ্গিমায় এসেছে। “কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে-আমি ভুবন ভুলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে” কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মনোমুগ্ধকর গান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কৃষ্ণচূড়ার তাৎপর্য।

রাস্তার মোড়ে মোড়ে, স্কুল কিম্বা কলেজ মাঠে,অফিস-আদালতের সামনে, বসত বাড়ির আঙিনায় অথবা দিগন্তজোড়া মাঠের রাস্তার দু-পাশে কৃষ্ণচূড়ার মনকাড়া গাছ। সবুজ সবুজ চিকন পাতা। ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল। দেখলেই যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। মন নেচে ওঠে আনন্দে। জেলার হোসেনপুর উপজেলার এসিল্যান্ড অফিসের সামনে প্রকৃতির বরণডালা সাজিয়ে রেখেছে কৃষ্ণচূড়ার গাছ এর আলাভোলা সৌন্দর্য যে কাউকেই সহজে মুগ্ধ করে। অন্যদিকে বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুর থেকে আগর পুর যাওয়ার রাস্তায় চোখে পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ-তরুণী বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত,টিকটকারদের যেন বারামখানা। রাস্তার দু-ধারে কৃষ্ণচূড়ার সারি বদ্ধ গাছ তার ফুলের লাল রঙ প্রকৃতিতে যেন অনুরাগের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।বিশেষ করে ভাগলপুরে দূর-দূরান্ত থেকে শত শত প্রকৃতি প্রেমীরা ছুটে আসছেন বলে জানান, স্থানীয়রা। নিকলী উপজেলা সত্তরে,কিশোরগঞ্জ সদর যসোদল কালীবাড়ি মোড়েও প্রকৃতির সাথে প্রেম লীলায় মত্ত কৃষ্ণচূড়া।

এই গাছ চমৎকার পাতা পল্পব এবং আগুনলাল কৃষ্ণচূড়া-ফুলের জন্য প্রসিদ্ধ। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল-কমলা-হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা একে অন্যরকম দৃষ্টিনন্দন করে তোলে।

জানা যায়, কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি সিসালপিনিয়েসি গোত্রের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদের আদিনিবাস মাদাগাস্কার হলেও ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ অনেকে দেশেই এর বিস্তৃতি। কৃষ্ণচূড়া গাছের আরেক নাম গুলমোহর। যদিও তা কম লোকই জানেন, কিন্তু কৃষ্ণচূড়াকে চেনেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া দায়। কৃষ্ণচূড়াকে সাধারণত আমরা লাল রঙেই দেখতে অভ্যস্ত হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষ্ণচূড়া লাল, হলুদ ও সাদা রঙেরও হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে লাল ও হলুদ রঙের ফুল দেখা গেলেও সাদা রঙের কৃষ্ণচূড়া দেখাই যায় না। ভিনদেশি হওয়ার পরও কৃষ্ণচূড়া আমাদের দেশি ফুলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, কৃষ্ণচূড়া উদ্ভিদের লাল, কমলা, হলুদ ফুল এবং উজ্জ্বল সবুজ পাতা অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য দায়ী আর এই বিভিন্ন রং মূলত ক্লোরোফিল, কারোটেনোয়েডস ও অ্যানথোসাইনিন নামক রঞ্জক পদার্থের উপস্থিতির কারণেই হয়ে থাকে।

কৃষ্ণচূড়া ফুল বাংলাদেশের প্রকৃতি পরিবেশ ও ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে মিশে আছে যুগ যুগ ধরে। বসন্তের শেষে গ্রীষ্মের আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতিকে নতুন করে সাজিয়ে তোলে কৃষ্ণচূড়া। গাছের ডালে ডালে সবুজ পাতার ফাঁকে উকি দেয়া টকটকে লাল রঙের বাহারী ফুলে ভরে যায় গাছ। ফুল গন্ধহীন, পাপড়ি পাঁচটি, নমনীয় কোমল, মাঝে লম্বা পরাগদ- অবস্থিত। ফুল ফুটন্ত কৃষ্ণচূড়া গাছের মনোরম দৃশ্য দেখে যে কেউ থমকে দাঁড়াবে ও মনে আনন্দের ঢেউ জাগাবে।

বসন্তের আগমনে গাছে নতুন পাতা গজায়। পাতা ক্ষুদ্র, যৌগিক ও চিরুনির মতো সাজানো থাকে। ফুল শেষে গাছে ফল ধরে। ফলের আকার চ্যাপ্টা লম্বা, দেখতে তলোয়ার শিমের আকৃতির, ফলের রঙ প্রথমে সবুজ ও পরিপক্ক হলে কালচে রঙ ধারন করে। ফলের অভ্যন্তরে বীজ হয়, বীজের রঙ কালো। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার হয়। গাছ দ্রত বর্ধনশীল, সাধারণত বীজ/চারা রোপনের ৫ থেকে ৬ বছর বয়সে গাছে ফুল ফুটে। গাছের কাঠ মাঝারি শক্ত মানের, খুব বেশী শক্ত মানের নয় বলে জ্বালানির লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ অন্য কাজে তেমন ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়না। উঁচু ভূমি কৃষ্ণচূড়া গাছ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান। 

কৃষ্ণচূড়া ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অপরূপ সৌন্দর্য ছাড়াও এর পাতা, মূলের বাকল ও ফুল ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন যা জ্বর ও খুশকি নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। ভেষজটি হেমিপ্লেজিয়া, আর্থ্রাইটিস এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমানোর জন্য কৃষ্ণচূড়া গাছ লাগানো খুবই কার্যকরী উপায়। কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য অমর হয়ে বেঁচে থাকুক যুগের পর যুগ। আপন মায়ার চাদর আকাশে ছড়িয়ে মেলে ধরুক স্বপ্নময় নয়নাভিরাম কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সৌন্দর্য।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker