কিশোরগঞ্জ

শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের ২৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী

বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্যের পথিকৃৎ, ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ্ব জহুরুল ইসলামের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৯৫ সালের এই দিনে ৬৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। 

 বুধবার(১৯ শে অক্টোবর), কিংবদন্তি উদ্যোক্তা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গেমচেঞ্জার,অক্লান্ত পরিশ্রমী নিষ্ঠাবান এ মহাপুরুষের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।

ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, সমাজসেবী, ইসলাম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম। যার শ্রম, মেধায়, সততা, একনিষ্ঠতা, আত্মবিশ্বাস, সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও বিপ্লবী পরিবর্তন এসেছে। তাঁর সময়ে সকল ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পকারখানা ছিল অবাঙালিদের একচেটিয়া দখলে। তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যে কয়েকজন বাঙালি ব্যবসাক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন, জহুরুল ইসলাম তাঁদের অন্যতম। ভাগ্যান্বেষণে সততা-পরিশ্রম-আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে একজন মানুষ কত মহীয়ান-গরীয়ান হতে পারেন, সেই বিস্ময়কর উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন আলহাজ্ব জহিরুল ইসলাম। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে প্রবল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যতার কারণে তিনি উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। ১৯৪৮ সালে তিনি তৎকালীন সিএন্ডবি-তে স্বল্প বেতনে যোগদান করেন। জহুরুল ইসলাম সিএন্ডবিতে অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং সে অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে তিনি বৃহত্তর কিছু করার জন্য জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। শুরু করেন তিনি ক্ষুদ্র ঠিকাদারি ব্যবসা। অচিরেই তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় প্রসার লাভ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন;বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন; যা তাঁর দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বৃহৎ ও প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। জহুরুল ইসলাম ছিলেন আত্মপ্রচার বিমুখ এবং সরলসোজা জীবনে বিশ্বাসী এক ধর্মভীরু ব্যক্তিত্ব। তিনি কর্ম সংস্থান করেছেন লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য, কিন্তু এসবের জন্য তিনি কখনো আত্মপ্রচারে নামেননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ধর্মভীরু। তিনি মসজিদ নির্মাণ করেছেন এবং অন্যদের মসজিদ নির্মাণে সাহায্য করেছেন। বহু আলেমকে নিজ খরচে হজ্বে পাঠিয়েছেন। 

জহুরুল ইসলাম ১৯২৮ সালে ১ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলা বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ্ব আফতাব উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন বাজিতপুর পৌরসভার (১৯৫৮-১৯৬১) সালের চেয়ারম্যান। এলাকার জনহিতকর কর্মকাণ্ডে তার ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। তার মা রহিমা খাতুন ছিলেন মহিয়ষী দানবীর নারী।তার পুণ্যতা, দানশীলতা, বদান্যতা আজো এলাকায় মুখে মুখে আলোচিত ও প্রশংসিত।তার দাদা হাফেজ আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন বাজিতপুরের সুপরিচিত মুখ। ছোট বেলায় জহুরুল ইসলাম ছিলেন বিনয়ী মিশুক ও দুরন্ত প্রকৃতির। সমবয়সীদের সাথে ঘুরে বেড়ানো এবং খেলাধুলায় ছিল খুব আগ্রহ। গরীব দু:খীদের পাশে দাড়িয়ে সহযোগীতা করার সভাব ছিল ছোটবেলা থেকেই। স্থানীয় স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে কিছু দিনের জন্য সরারচর শিবনাথ হাই স্কুলে পড়েন। সে খান থেকে স্কুল পরিবর্তন করে বাজিতপুর হাই স্কুলে ভর্তি হন। লেখা-পড়ার এক প্রর্যায়ে চাচার সাথে কলকাতায় চলে যান। সে খানে রিপন হাই স্কুল থেকে ইংরেজি মিডিয়ামে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে বর্ধমান কলেজে ভর্তি হন। পরে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হয়ে মেধা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্রতার কারণে লেখা-পড়া চালিয়ে যাওয়া হয়নি তার। আর্থিক অসচ্ছলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ১৯৪৮ সালে ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সি এন্ড বি এর ওয়ার্ক এ্যাসিসটেন্ট হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করেন। এখানে ৩ বছর সুনামের সাথে চাকরি করার পর ১৯৫১ সালে পদত্যাগ করে ছোট-খাট ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। প্রথমদিকে তার পিতার সাহায়তাকারী হিসাবে বিভিন্ন স্থানে পরিচিত হন। পরবর্তিতে নিজেই ঠিকাদার হিসাবে তালিকাভূক্ত হন। ঠিকাদার হিসাবে তার প্রথম কাজ হল সরকারি অফিসে বার শত টাকার স্টেশনারী দ্রব্য সরবরাহ করা। দ্বিতীয় কাজ কিশোরগঞ্জ পোষ্ট অফিস ঘর নির্মাণ। এই ভাবে একের পর এক কাজ আসে ব্যস্ত হয়ে পরেন তিনি। এরই মধ্যে জহুরুল ইসলাম প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসাবে স্বীকৃতি পান। কঠিন শ্রম, মেধা আর ধৈর্য সাহস নিয়ে সৃষ্টি করতে থাকেন দেশের সরকারি এবং বেসরকারি বড় বড় ভবন, রাস্তা, ঘাট। জহুরুল ইসলাম শুধু বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার ছিলেননা। ঠিকাদারী ব্যবসায়ের পাশাপাশি তিনি সমগ্র বিশ্বে প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসাবে সুনামের সহিত আমৃত্যু কাজ করেছেন। তিনি ঠিকাদারির পাশা পাশি বিভিন্ন ব্যবসার মাঝে মনযোগ দেন। ১৯৭২-এর পর থেকে বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোগে জহুরুল ইসলামের কর্মযজ্ঞ আরো বিস্তৃতি লাভ করে। ১৯৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (বিডিসি)। এ কর্পোরেশন বাংলাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠান যা মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্মাণ ব্যবসা শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য ব্যবসার মধ্যে রয়েছে নতুন প্রযুক্তিতে আবুধাবিতে ৫০০০ বাড়ি নির্মাণ, ইরাক ও ইয়েমেনে উপশহর নির্মাণ ইত্যাদি। এই সকল কাজের মাধ্যমে তিনি দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। কৃষি, পোলট্রি, ফিশারিজ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি উন্মোচন করেন নতুন দিগন্তের, তাঁর এই আইডিয়া থেকে আজ বাংলাদেশে এসব খাতে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ হচ্ছে।

★তার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলো হলোঃ

১। ইষ্টার্ণ হাউজিং লিমিটেড, ২। নাভানা গ্রুপ লিমিটেড, ৩। আফতাব অটোমোবাইলস, ৪। নাভানা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ৫। ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড. ৬। ঢাকা ফাইবার্স লিমিটেড, ৭। নাভানা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড, ৮। দি মিলনার্স ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, ৯। ইষ্টার্ণ এষ্টেটস লিমিটেড, ১০। ভাগলপুর ফার্মস লিমিটেড, ১১। মিলনার্স টিউব ওয়েলস লিমিটেড, ১২। এসেনশিয়াল প্রডাক্টস লিমিটেড, ১৩। ইসলাম ব্রাদার্স প্রেপাটিজ লিমিটেড, ১৪। জহিরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজ

জহুরুল ইসলামের জীবনচরিত ও বিশাল কর্মকাণ্ড স্বল্প কথায় সহজে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কিংবদন্তি উদ্যোক্তা, অক্লান্ত পরিশ্রমী নিষ্ঠাবান এ মহাপুরুষের কর্মপরিকল্পনা ছিল অসীম যা তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। স্বল্প সময়ে তিনি যে বিশাল কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন, মানবিক ও চারিত্রিক গুণাবলির যে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন তা বাঙালি জাতির আদর্শ, কর্মোদ্যোগ ও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন এবং ভাগলপুরে নিজ গ্রামে সমাহিত হন। পরম করুণাময় তার আত্মার শান্তি দান করুন।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker