“সবুজ ধান ক্ষেতে বিকেলের হাসি,
চক চক করে দিগন্ত পরী।
চিল মেঘ ঘেঁষে ডানা মেলে উড়ে,
চলন্ত ছায়া ধান ক্ষেতে পড়ে।
ফড়িঙ্গের উড়াউড়ি ঐ ছায়া জুড়ে,
দিন শেষে যায় ঘরে ফিরে।”
কবিতার পংক্তি গুলোর মতো চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে ইরি-বোরো ধানের আবাদি বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ চারিদিকে সবুজের সমারোহ। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো খেলে যাচ্ছে সবুজ ধানের পাতাগুলো। আর এমন সবুজ সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে উঠছে কৃষকের স্বপ্ন। ক’দিন পরেই সবুজ চারাগুলো হলুদ বর্ণ ধারণ করবে। এরপর সোনালী ধানের শীষে ঝলমল করবে মাঠের পর মাঠ। রাশি রাশি সোনালী ধানে ভরে উঠবে কৃষাণীর শূন্য গোলা। ধান বিক্রিতে পরিশোধ হবে দেনা ঋণের বোঝা, মিটাবে সংসারের ভরণ-পোষণ, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ও নতুন জামার বায়না, কৃষাণীর গায়ে জড়াবে নতুন শাড়ি।
ধান ক্ষেতের সবুজমুখ দর্শনে এমন স্নিগ্ধ ভাবনায় মনোনিবেশন করে কবি সাহিত্যিক কিম্বা সাংবাদিক।
অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ এর মনেও সবুজের বিস্তৃত রুপ ঢেউ খেলে যায়,প্রকাশিত হয় কলম ও খাতার মধুময় স্পর্শে।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুররের চরকাটি হারী গ্রামের প্রান্তিক কৃষক সাইফুল তার পাঁচবিঘা জমিতে এবার বোরো চাষ করেছেন। সুষ্ঠু সবল সবুজ ধানের চারাগুলো হাতড়াচ্ছিলেন তিনি। এমন সুন্দর চারা দেখে তার মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে। প্রত্যুষে কাক ডাকা ভোরে খেতের আইলে- আইলে ঘোরে ধান ফলানোর স্বপ্নে বিভোর । সন্তানের মতো স্নেহের স্পর্শে ধানের চারায় পরিচর্যা করে কাটছে কৃষকের দিন। কৃষাণি ধানের আগমনী বার্তায় ধানের গোলা, কুলো, খাঁচা ইত্যাদি গোছানোর কাজে ব্যস্ত। এবছর সার ও বিদ্যুতের কোনো সংকট না থাকায় খুবই ভালো ফলনের আশা করছেন তিনি। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে চলতি বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘায় অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ মণ ধান উৎপাদন হবে বলে জানান তিনি।
একই গ্রামের কৃষক গোলাপ চার বিঘা জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছেন। নিজ জমিতে বালাইনাশক দিতে গিয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত ধানের কোনো ক্ষতি হয়নি। ফলন খুব ভালো হবে।
উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের সাহেবের চর গ্রামের প্রান্তিক কৃষক নজরুল ইসলাম, চর বিশ্বনাথ পুর গ্রামের আব্দুস সালাম, দক্ষিণ পুমদী গ্রামের সবুজসহ অনেকেই বলেন, এবছর সারের কোনো সংকট হয়নি। যে কারণে ফসলের চেহারা অনেক সুন্দর হয়েছে। সবল-সতেজ চারাগুলো দেখে মনে হয় ধানের ব্যাপক ফলন হবে। তারা আরও বলেন, এ অঞ্চল বোরো চাষের ওপর নির্ভরশীল। ভালোভাবে এ বোরো ফসল ঘরে তুলতে পারলে তাদের সারা বছরের চাহিদা পূরণ হয়। এ কারণেই বোরো মৌসুকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখে এ অঞ্চলের চাষিরা। যথা সময়ে সার, বালাইনাশক ও সেচ দিতে পারায় প্রাথমিকভাবে চারাগুলো উজ্জীবিত রয়েছে। ধান গাছে শীষ গজানো থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো ফলন হবে বলে জানান কৃষকেরা।
উপজেলার সাহেবের চর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া এ বছর ৫ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেছেন।জানতে চাইলে তিনি মৃদু হেসে বলেন,
“এবার বাম্পার ধান অইব মনে অয়তাছে,আল্লাহ যুদি কোনো পাক্কিতিক দুয্যুক(প্রাকৃতিক দূর্যোগ) না দেয় তাইলে আর সমেস্যা নাইগা”।
তবে বাজারে ধানের পর্যাপ্ত মূল্য না থাকায় হতাশাও প্রকাশ করেছেন চাষিরা। কৃষকদের দাবি, এক বিঘা জমিতে ধান উৎপাদনে যে পরিশ্রম আর ব্যয় করা হয়, সে তুলনায় ধানের মূল্য তারা পাচ্ছেন না। ফলে ধান চাষের আগ্রহও হারিয়ে ফেলছেন অনেক কৃষক। তাদের দাবি সরকার যেমন করে সার-বীজ, কীটনাশক ও বিদ্যুতের ঘাটতি মিটিয়েছে, তেমনই ধানের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করলে প্রান্তিক চাষিদের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচে যাবে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, এবছর উপজেলায় ৮ হাজার তিনশ’ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি পরিমাণে ধান আবাদ করেছে কৃষক। এবার এখন পর্যন্ত বোরো চাষে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। সার, বীজ ও বালাইনাশক সংকট ছিল না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ ইমরুল কায়েস জানান, এবছর উপজেলায় ৮ হাজার তিনশো হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় অধিক। পরবর্তী আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ও কোনো প্রকার প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে হোসেনপুরে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।