দেশে চাহিদার চেয়ে পশুখাদ্য ভুসির উৎপাদন বেশি। এর পরও ইচ্ছামতো আমদানি করা হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের মিলগুলো। এর প্রভাব পড়েছে আটা-ময়দা উৎপাদনে।
বাজারে ভুসি বিক্রি করতে না পেরে এরই মধ্যে আটা-ময়দার অর্ধেক মিল-কারখানা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। ভুসি আমদানি অব্যাহত থাকলে দেশি মিলগুলোর উৎপাদন আরো ব্যাহত হয়ে বাজারে আটা-ময়দার সরবরাহে সংকট তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে নিম্নমানের আমদানি করা ভুসি পশুখাদ্যের জন্য হুমকি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এই পরিস্থিতিতে ভুসি আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে বর্তমানে ছোট-বড় মিলিয়ে আটা-ময়দার প্রায় এক হাজার ১০০ মিল-কারখানা রয়েছে। গম থেকে আটা-ময়দা উৎপাদনের সময় প্রায় ৩০ শতাংশ ভুসি তৈরি হয়। এই ভুসি বাজারজাত করতে না পেরে এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক মিল-কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে।
দেশে বছরে গমের চাহিদা ৭৫ লাখ মেট্রিক টন।
এর মধ্যে আমদানি করা হয় ৬৫ লাখ টন। বাকি ১০ লাখ টন গম দেশে উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে দেশে বছরে ভুসির চাহিদা রয়েছে ২১ লাখ ৯০ হাজার টন। এর মধ্যে দেশের বড় কারখানাগুলোর ভুসি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে ২২ লাখ ৫০ হাজার টন। চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হওয়ার পরও আমদানি করা হচ্ছে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশি শিল্প।
বিশ্বে গম রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইউক্রেন, রাশিয়া ও ভারত। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই তিন দেশ থেকে গম আমদানির সুযোগ নেই। বিকল্প হিসেবে বাড়তি দামে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, রুমানিয়া ও কানাডা থেকে গম আমদানি করা হচ্ছে। আর ভুসি আমদানি করা হচ্ছে ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে।
মিল মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভুসি আমদানিতে শুল্কহার পর্যালোচনা বিষয়ে গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিরা। মিল-কারখানা মালিকদের প্রতিনিধিরাও ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন।
মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র জিএম তসলিম শাহরিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে ব্যাপকভাবে ভুসি আমদানি হওয়ায় দেশি মিল মালিকরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ভারত বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ রাখলেও ভুসি রপ্তানি করছে। এতে দেশিয় কারখানায় উৎপাদিত ভুসি বিক্রি কমে মিলগুলোয় বড় স্তূপ জমে গেছে।
তিনি বলেন, ভুসি বিক্রি করতে না পারলে মিল-কারখানার মালিকরা গম আমদানিতে নিরুৎসাহ হবেন। বন্ধ হতে থাকবে দেশের আটা-ময়দার মিল-কারখানা। এতে বাজারে আটা-ময়দা সরবরাহে সংকট তৈরি হতে পারে। ভুসি আমদানি নিরুৎসাহ করে দেশি কারখানার ভুসি বিক্রির সুযোগ বাড়ালে আরো কম দামে ভোক্তারা আটা-ময়দা কিনতে পারবে।
নারায়ণগঞ্জ আটা-ময়দা মিল মালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন মৃধা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানি করা ভুসি খুবই নিম্নমানের। ফলে এসব ভুসি কিছুটা কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে আমাদের দেশের মিল মালিকরা উৎপাদন করা ভুসি বিক্রি করতে পারছেন না। ভুসি আমদানিতে আটা-ময়দা আমদানির সমান শুল্ক আরোপ করার দাবি জানাচ্ছি।’
জানতে চাইলে বসুন্ধরা ফুডের বিভাগীয় প্রধান (বিক্রয় ও বিতরণ) রেদোয়ানুর রহমান বলেন, বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ ভুসির চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে বেশি ভুসি দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। সাধারণত গম থেকে ৩০ শতাংশ ভুসি উৎপাদিত হয়। কারখানাগুলোয় উৎপাদিত ভুসি চার থেকে পাঁচ দিনের বেশি মজুদ রাখা যায় না। আবার মজুদ ভুসি বিক্রি করতে না পারলে নতুন করে উৎপাদনে যেতে পারে না কারখানাগুলো। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক কারখানা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এভাবে চলতে থাকলে বাজারে আটা-ময়দার সরবরাহ সংকট তৈরি হয়ে দাম বেড়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা নিম্নমানের ভুসিতে সয়লাব বাজার। এই আমদানিকারকদের নিতে হয় না বিএসটিআই সনদ, প্রয়োজন হয় না মান পরীক্ষারও। এসব নিম্নমানের ভুসির কারণে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশি কম্পানিগুলো, অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ খাতও হুমকিতে পড়েছে। আবার দেশের আটা-ময়দার মিলগুলোয় পর্যাপ্ত ভুসি থাকার পরও আমদানি করায় দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। ডলার সংকটে জ্বালানি ও জরুরি খাদ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
রেদোয়ানুর রহমান আরো বলেন, বর্তমানে আমদানি করা আটা-ময়দায় ৩৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়, কিন্তু এর উপজাত (বাই প্রডাক্ট) ভুসিতে দিতে হয় মাত্র ৫ শতাংশ শুল্ক। যদিও পশুখাদ্য উৎপাদনকারী কম্পানিগুলো বিনা শুল্কে ভুসি আমদানি করতে পারছে। এসব নিম্নমানের ভুসি দেশের নামিদামি কম্পানির বস্তা নকল করে বাজারজাত করা হচ্ছে। ফলে খামারিরা মানসম্পন্ন পশুখাদ্য পাচ্ছেন না।
এসিআই গ্রুপের সিনিয়র জিএম অবন্তী কুমার সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিম্নমানের আমদানি করা ভুসিতে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। অথচ আমাদের উৎপাদিত ভুসি বিক্রি করতে পারছি না। আমদানি করা ভুসি দেশের নামিদামি কম্পানির বস্তা নকল করে ফাঁকি দিয়ে মানুষের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদেরটাও বন্ধের পথে। ভুসি বিক্রি করতে না পারায় আটা-ময়াদার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশে আটা-ময়দার দাম আরো বাড়বে।’
দ্বিগুণ ভুসি আমদানি
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দুই লাখ ৩৩ হাজার ৪১৬ মেট্রিক টন ভুসি আমদানি করা হয়। আর চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে চার লাখ ৩৯ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন ভুসি আমদানি করা হয়েছে। গত বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে প্রায় দ্বিগুণ ভুসি আমদানি করা হয়েছে।
দেশে আটা-ময়দা ও ভুসি উৎপাদনে শীর্ষে যারা
আটা-ময়দা ও ভুসি উৎপাদন এবং বাজারজাতে দেশের বাজারে শীর্ষে থাকা কম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, এসিআই গ্রুপ, টিকে গ্রুপ ও ইফাদ গ্রুপ।
নামিদামি কম্পানির মোড়কে নিম্নমানের ভুসি বিক্রি
আমদানি করা নিম্নমানের ভুসি দেশের বড় কম্পানিগুলোর বস্তা বা মোড়ক নকল করে বাজারজাত করছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সম্প্রতি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বসুন্ধরা গ্রুপের লেবেলযুক্ত বস্তায় নিম্নমানের ভুসি বিক্রির অভিযোগে দুই ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে হোসেনপুরের হাজীপুর বাজারের ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিনকে পাঁচ হাজার টাকা এবং কুড়িঘাট হনুমানতলা বাজারের ব্যবসায়ী আসলাম হোসেনকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার পাশাপাশি নকল মোড়কের ২১ বস্তা নিম্নমানের ভুসি জব্দ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন হোসেনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিন্দ্য মণ্ডল।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ডা. মো. নাজমুল হক বলেন, ‘আমরা ভেজাল গোখাদ্যের (ভুসি) বিষয়ে কঠোর অবস্থানে। বিশেষ করে আমদানি করা ভুসিতে ভেজাল পাওয়া গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। পশুর জন্য ক্ষতিকর আমদানি করা এসব ভুসির ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে।’ ভেজাল ভুসি না কেনার জন্য খামারিদের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।