দুরুন্ত ডানপিটে একটা বালক শত চঞ্চলতার ভিড়ে পরোপকার করে বেড়ানো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে আব্দুল কদ্দুছ। হাসিমাখা বদনে পুরু গ্রাম ঝাপিয়ে বেড়াতেন রঙ্গ রসে হাজারো বন্ধু বান্ধব ঘিরে অতিবাহিত হতো দিন, দশম শ্রেনীতে পড়ুয়া কদ্দুছের।
ছাত্র হিসেবেও ছিলেন মেধাবী। ছিলেন গ্রামবাসী তথা আত্নীয় স্বজনের প্রিয় পাত্র।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের সাহেবের চরের বাসিন্দা, বৃহৎ বংশ হাজী বংশের গিয়াসউদ্দিনের একমাত্র পুত্র আব্দুল কদ্দুছ পিতা গিয়াসউদ্দিন অঢেল সম্পত্তির মালিক তবুও ছেলের বায়না রাখতে প্রবাসে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। তৎকালীন হোসেনপুর পরিসংখ্যান অফিসে কর্মরত গফরগাঁও এর কান্দিপাড়ার আ: আওয়াল আব্দুল কদ্দুছের মামা তার হাত ধরে পাড়ি জমান সুদূর প্রবাসে ১৬/১৭ বছরের যুবক। চলে যান সৌদি আরবে। এটা ১৯৯৬ সালে তখনকার সময়ের সাহেবের চর গ্রামের প্রথম প্রবাসী কদ্দুছ। কাজ পেয়ে যান সৌদি এয়ার লাইন্সে জেদ্দা কেন্দারায় অবস্থিত। থাকতেন পুরাতন এয়ারপোর্টের সাথে আরব সাগর পাড়ে আদম হাওয়া কবরস্থান ও জমজম মসজিদ সংলগ্ন। টানা ১২ বছর বিদেশ থেকে উপার্জন করেছেন কোটি কোটি টাকা। জানা যায়- সৌদিতে বিভিন্ন হালাল ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলেন।
গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মারফত জানা যায়, আব্দুল কদ্দুছ বিদেশের মাটিতেও ছিলেন বাঙ্গালী জাতীর উপকারে নিবেদিত প্রাণ। ছিলনা তার মনে কোন হিংসা বা বিরক্তি। বিভিন্ন পথে করতেন বাঙ্গালীর উপকার। কোন বাঙ্গালী সৌদিতে অবস্থানরত বিপদগামী হলে পাশে আপনজন হিসেবে পেতেন তাকে। নতুন প্রবাসীরা দালালের ভুয়া চাতুরীতে পরে সৌদি গেলে নিজের বাসায় রেখে সমস্ত কিছু যোগান দিতেন তিনি। নিজের খরচে কাজ বের করে দিতেন আবার কেউ অবৈধ হয়ে গেলে আশ্রয় পেতেন তার নিকট। নিজের খরচে দেশে প্রেরণও করতেন তিনি।
আরো জানা যায়, আপন গ্রামের এবং আত্নীয়দের অনেকেই তার দ্বারা অসহায়ত্বের জীবন থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। সর্বোপরি আব্দুল কদ্দুছ একজন দানবীর ও অসহায় মানুষের পরম বন্ধু। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে একটি মাত্র দূর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে হারিয়ে যায় তার নিজের জীবনের রাজকীয় সুখ-শান্তি।
মিশন ৯০ জানতে পারে- আব্দুল কদ্দুছ ২০০৭ সালের প্রথম দিকে তিনি দেশে ফিরেন। শত মানুষ ভীড় করতো তাকে দেখতে। আত্নীয় বন্ধু বান্ধবদের কোন অভাব ছিলনা আদর আহ্লাদের কদ্দুছেই যেন তাদের একমাত্র আপন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে- তার বাড়ীর সোফা সেট গুলিতে হামেশাই আনন্দে গড়াগড়ি করতো বংশীয় লোকজন। এমনও দেখা মিলে জমিতে কাজ করার পর গায়ে কাঁদা মাখা অবস্থায় তার ঘরের সোফাতে বসে আরাম করতেন আর মনের সুখে সুবোধ বিড়ি টানতেন। সরলমনা কদ্দুছ বা তার পরিবার কখনো বিরক্তবোধ করতেন না। আব্দুল কদ্দুছ পাঁচ বোনের মাঝে এক ভাই, অত্যন্ত আদরের।
দেশে ফিরার কয়েকদিনের মধ্যেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন গফরগাঁও উপজেলার মোহাম্মদ মুনসুরের মেয়ে ঢাকাস্থ পিজি হাসপাতালের তৎকালীন ভাইস- চ্যান্সেলর ডাক্তার হাদির ভাতিজি আফসানা মিমি হাসির সাথে ২০০৭ সালে। অনন্ত সুখে অতিবাহিত হচ্ছিল জীবন।
কিন্তু সুখ যদি মরিচিকার রুপধারন করে একটা মানুষের কিছুই করার থাকেনা। বিয়ের দু- মাস অতিবাহিত হবার পর কদ্দুছের জীবনে নেমে আসে শোকের কালো ছায়া ২০০৭ এর পবিত্র ঈদ- উল- আযহার বিকেল বেলা ঘুরতে বের হোন মোটরসাইকেলে সুদুর্ষন যুবক কদ্দুছ। তাকে দেখলে বলিউডের নায়কদের মত দেখা যেত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো সকল মানুষ। বেশভূষায় সর্বদা পরিচ্ছন্নতা, দামী আংটি, ব্রেসলেট শোভা বাড়াতো স্মার্ট দেহের। হোসেনপুর ব্রীজ হয়ে গফরগাও অভিমুখি গফরগাঁও এর পাঁচভাগ ইউনিয়নের পালের বাজার নামক স্থানে হঠাৎ মোটরসাইকেল ফাঁকা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। তার সাথে একই মোটরসাইকেলে আশরাফুল ইসলাম নামে এক যুবক ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান কদ্দুছ পড়ে যান মোটারসাইকেলের নিচে আর আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েন আশরাফুল। তার কোনক্ষরেও কিছু হয়নি।
আশেপাশের দোকানী ও পথচারীরা ছুটে এসে তাকে মোটরসাইকেলের নিচ থেকে উদ্ধার করে। হালকা ব্যাথা অনুভূত হয় মেরুদণ্ডে। দ্রুত গফরগাও হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে আবার ময়মনসিংহের চরপাড়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্থানান্তর করা হয়। একপর্যায়ে অবস্থার অবনতি হলে নেয়া হয় ঢাকা পিজিতে। ৮ মাস ডাক্তারী বোর্ড বসিয়ে উন্নত চিকিৎসা করা হয়। আর আগের জীবনে ফেরা হয়নি তার। বাড়ী নিয়ে আসেন হুইল চেয়ার, এখন তার নিত্যসাথী। হাত- পা অবশ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যবান হওয়ায় তাকে গোসলখানা অবধি নিতে প্রয়োজন হয় দুজন লোকের। এভাবেই দূর্বিষহ যন্ত্রণা ভোগ করে চলছে তার জীবন। কান্না তার প্রতিদিনের সঙ্গী।
অন্যদিকে নিজের জীবনের করুন অবস্থা দেখে স্ত্রীকে বুজিয়ে শুনিয়ে মুক্তি দিয়ে দেন তার কষ্টের জীবন থেকে। তার স্ত্রী হাসির সুন্দর ভবিষ্যৎটা নতুন করে সাজাতে চাইলেন তিনি। ২০০৯ সালে বিচ্ছেদ হয় দুজনার।
তার দুঃখী জীবনের একমুঠো খুশি যোগাতে মা এবং বোনদের ছাড়া কেউ রইলনা। আর কেউ আসেনা তাকে ভালোবাসতে খবর নিতে। তার সাথে আলাপকালে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং আমাদের বলেন- আমি অসুস্থ আছি যতটা কষ্ট না হয়। তার থেকে বেশি কষ্ট হয় যখন মনে পড়ে মানুষের জন্য এতো করে বিনিময় কি পেলাম? আমি অসুস্থ তাই মা বোন- ভগ্নিপতি ছাড়া কেউ কোন খোঁজ খবর নেয় না। তাছাড়া যখন আমি এক্সিডেন্ট করি এ খবর শোনা মাত্রই যে সকল নিকটতম লোকদের কাছে টাকা পয়সা পেতাম অধিকাংশ বেইমানি করেছে।
তিনি আরো বলেন, আমার চিকিৎসা বাবদ প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। বহু ভন্ড কবিরাজরাও লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়েছে আমার দূর্বলতার সুযোগে। এখন আর কোন চেষ্টা করিনা। মৃত্যুর প্রহর গুনছি। এ জীবন আর ভালো লাগেনা ১৫ বছর থেকে এমন কত আর ভালো লাগে?
সরেজমিনে দেখতে পাই – এখনো নিজে শারীরিক দুরবস্থায় থাকলেও, সাধ্যমত মানব সেবা করে থাকেন। নদী ভাঙ্গনে অনেক ভূমিহীন সরকারী সহযোগিতা না পেলেও পেয়েছেন তার কাছে বসবাস করার মত জমি।আব্দুল কদ্দুছকে নিয়ে বিভিও প্রতিবেদন থাকবে শুধুমাত্র মিশন ৯০ অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে। যুক্ত থাকুন মিশন ৯০ এর সাথে।
প্রকৃতপক্ষে মিছে, এ দুনিয়ার মোহ মায়া। যতক্ষণ সুস্থ এবং টাকা আছে একটা মানুষের ততক্ষণ ভালোবাসার অভাব নাই। সুস্থতা নাই তো দুনিয়ায় কিছুই নাই।