নড়াইল

নড়াইলে বর্ষা মৌশুমে কয়েক দফা ভারী বর্ষনে মৎস্য ও কৃষি খাতে ক্ষতি শত কোটি টাকা

জেলায় এক হাজার সাত শত হেক্টর জমিতে মোট ঘের রয়েছে পাঁচ হাজার তিন শত টি, বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর, এ অঞ্চলের ছেষট্টি শতাংশ ঘের পানির নিচে তলিয়ে গেছে, ফলে মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত নব্বই কোটি টাকা। এদিকে আমন ধান, ঘেরের পাড়ে শিম, কুমড়া, শশা, পেপেসহ বিভিন্ন প্রকার সব্জী তলিয়ে যাওয়ায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত দশ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অতি বৃষ্টিতে এ জনপদে মৎস্য ও কৃষি খাতে ক্ষতির পরিমান শতকোটি টাকা।

চলতি বছর সারাদেশের ন্যায় নড়াইলে কয়েক দফায় ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। টানা কয়েকদিনের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে জেলার অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। মৎস্য ব্যাবসায়ীদের পাশাপাশি মারাক্তকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে হাজারো কৃষক। ভারি বৃষ্টিতে কৃষকদের ক্ষেতের সজ্বীসহ বিভিন্ন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। চলতি মৌশুমে শুধুমাত্র  বৃষ্টিতে মৎস্য ব্যাবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে অন্তত নব্বই কোটি টাকা আর কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে আরও অন্তত দশ কোটি টাকা, সব মিলিয়ে ছোট্র জেলা নড়াইলে কৃষি ও মৎস্য খাতে ক্ষতির পরিমান অন্তত শত কোটি টাকা।

জানা গেছে, প্রায় আট লক্ষ মানুষের বসবাসের জেলা নড়াইল। বিল ও ঘের বেষ্টিত এ জনপদের  মানুষের প্রধান জীবীকার উৎস কৃষি কাজ ও মৎস্য চাষ। এ জনপদের ৮২ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। ধান, পাট, গমসহ বিভিন্ন ফসলের পাশাপাশি এ জেলার অন্তত ৫০ হাজার মানুষ মৎস্য চাষের সাথে সরাসরি জড়িত।

নড়াইল শহরের ঘের ব্যাবসায়ী কৃষক মো: আহাদউজ্জামান। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মৎস্য চাষের সাথে জড়িত। নড়াইল পৌর এলাকার ভওয়াখালী বিলের মধ্যে তিনটি ঘের রয়েছে তার। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার দেনা করে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে এ বছরও বিভিন্ন প্রকার মাছ চাষ শুরু করেছিলেন তিনি। টানা বৃষ্টিতে তার তিনটি ঘের তলিয়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে ঘেরের পাড়ের বিভিন্ন প্রকার সজ্বী। ঘের আর বিল পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে প্রান্তিক এই মৎস্য ব্যাবসায়ী ছয় লক্ষ টাকা খরচ করেছেন, ভেবেছিলেন অন্তত দশ লক্ষ টাকা লাভ হবে। তবে তার সেই স্বপ্ন নিমিষেই বিলিন হয়ে গেছে। ধার দেনা করে মাছ ছাড়লেও সব মাছ বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে। সমিতির লোনের টাকা আর মাছের খাবারের দোকানের বাকি টাকা কিভাবে শোধ করবে সেটা নিয়ে বড় দু:চিন্তায় আছে এই মৎস্য ব্যাবসায়ী।

কৃষক ও মৎস্য ব্যাবসায়ীরা জানান, জেলার বিল ও ঘের অঞ্চলের প্রতিটা এলাকার মৎস্য ব্যাবসায়ী ও কৃষকদের একই অবস্থা। চলতি মৌশুমের কয়েক দফা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে এলাকার রাস্তাঘাট, কৃষকদের ক্ষেতের ফসল, সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। আর এতে বিপাকে পড়েছে নড়াইল সদর, লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার হাজারো মৎস্য ব্যাবসায়ী ও কৃষক। চলতি মৌশুমের তিন দফা ভারী বর্ষনে জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নড়াইল সদর ও কালিয়া উপজেলার  মৎস্য চাষি ও প্রান্তিক কৃষকেরা। ঘের  ভেসে যাওযায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে তারা।

পৌর এলাকার দূর্গাপুর গ্রামের মৎস্য ব্যাবসায়ী জিরু শেখ বলেন, দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘের ব্যবসা করি, বৃষ্টিতে এত ক্ষতি কখনও হয়নি। সাড়ে তিন একর জমিতে দুটি ঘেরে যত মাছ ছিল সব চলে গেছে। অন্তত সাত লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবী তার। একই এলাকার আর এক ব্যাবসায়ী আজিজুর শেখ বলেন, পাঁচটি ঘেরের মধ্যে চারটি ঘেরের মাছ চলে গেছে, ঘেরের পাড়ের সব সজ্বী নষ্ট হয়ে গেছে এতে আট লক্ষ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। কৃষক খাজা মিয়া জানান, বিল আর ঘের চেনার উপায় নেই, সব পানিতে তলিয়ে গেছে। আড়পাড়া গ্রামের কৃষক তজিবর শেরেখ অভিযোগ, যে সকল জমিতে পায়ে হেটে যেতাম সেই জমিতে নৌকা ছাড়া যেতে পারছিনা, জমিতে কোন ফসল অবশিষ্ট নেই, সব নষ্ট হয়ে গেছে।

কৃষি বিভাগ ও মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় এক হাজার ৭শ হেক্টর জমিতে মোট ঘের রয়েছে পাঁচ হাজার তিন শত টি। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে অন্তত সাড়ে তিন হাজার ঘের ও পুকুর। এ অঞ্চলের ছেষট্টি শতাংশ ঘের পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এ জনপদে ঘের ব্যবসায়ী আছে সাড়ে দশ হাজার  আর এ পেশার সাথে জড়িত রয়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। মৎস্য চাষের সাথে জড়িত ব্যাবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত তেত্রিশ হাজার, আর শুধু মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত নব্বই কোটি টাকা। এদিকে আমন ধান, ঘেরের পাড়ে শিম, কুমড়া, শশা, পেপেসহ বিভিন্ন প্রকার সজ্বী তলিয়ে যাওয়ায় কৃষি খাতে ক্ষতি হয়েছে অন্তত দশ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অতি বৃষ্টিতে এ জনপদে ক্ষতির পরিমান শতকোটি টাকা।

জানা গেছে, নড়াইল খাদ্য ও মৎস্য চাষে উদ্বৃত্ত জেলা । এ জেলার প্রায় আট লক্ষ মানুষের জন্য মাছের চাহিদা রয়েছে ১৬ হাজার মে: ট:। প্রতি বছর  উৎপাদন হয় অন্তত ১৮ হাজার মে: ট: মাছ। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে অন্তত ২ হাজার মে: ট: মাছ উদ্বৃত্ত থাকে এ জেলায়। আর প্রতি বছর চাহিদা মিটেয়ে অন্তত এক লক্ষ মে: ট: খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে এ জনপদে।

নড়াইল কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: আশেক পারভেজ বলেন,  ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। তাদের মাঝে সরকারিভাবে বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হবে।  আশা করছি সার ও বীজ বীনা মূল্যে সরবরাহ করা হলে কিছুটা হলেও তারা ক্ষতি পুশিয়ে নিতে পারবে।

নড়াইল জেলা মৎস্য অফিসার এইচ এম বদরুজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ঘের ব্যাবসায়ীদের তালিকা করে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলে মৎস্য ব্যাবসায়ীদের সহযোগিতা করা হবে।  বরাদ্দ না পেলে অর্থিকভাবে সহযোগিতা করার কোন সুযোগ নেই। ব্যাবসায়ীরা যাতে আগামীতে ঘুরে দাড়াতে পারে সেই জন্য মাঠ পর্যায়ে তাদেরকে বিভিন্ন ভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে মাঠ কর্মীরা।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker