কিশোরগঞ্জ

লোকজ ঐতিহ্য কুলা, ঝনত ঝনত শব্দে মন ছুঁয়ে যায়

“আমি হলাম ভাঙা কুলা ফেলি চুলার ছাই,
এরপরে আর গিন্নির কাছে আমার কদর নাই”
নতুন থাকলে গিন্নি আমার গায়তো কত গান,
যতই আমি হচ্ছি পুরান কমছে ততোই মান।

অভিলাষ মাহমুদের  ‘ভাঙ্গা কুলার আত্নকথন’কবিতার এ পঙতিগুলি কুলার আবেগী নিগূঢ় মাহাত্ম্য ফুটিয়ে তুলে দক্ষিণা হিমেল বাতাসে ঐতিহ্যের জয়ধ্বনি ভাসিয়ে দেয়।যা জানান দেয় কুলা আমাদের গৃহস্থালির মুখ্য সরঞ্জাম। বাঙলার ঐতিহ্য ধারণকারী কিশোরগঞ্জের পল্লি গাঁয়ের পরতে পরতে  কৃষাণীদের গৃহকর্মের অবিচ্ছেদ্য সরঞ্জাম কুলা।

কুলো বা কুলা বড় সমতল তলাওয়ালা চ্যাপ্টা পাত্র যার একটি দিকের কানা খোলা। আকৃতি অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ইউ এর মত। বক্র দিকটি উঁচু কানাওয়ালা। সোজা দিকটি কানা ছাড়া।

Image

ধান ঝাড়তে, ধানের চিটা পরিষ্কারে কিম্বা বাদাম,গম,ভূট্টা,চাল,ডাল ইত্যাদি থেকে ময়লা আলাদা করতে ব্যবহার করা হয় কুলা।গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে সাজ-সজ্জার কাজে লাগে।নতুন বর-কনেকে বরণ করে নিতে ঐতিহ্যগত ভাবে এখনও কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে বরণ ডালা সাজানো হয় কুলায় ধান,দূর্বা,মিষ্টিসহ আনুষাঙ্গিক নৈবেদ্য। এছাড়াও পূজা অর্চনায় এ কুলা ব্যবহার করা হয়। কুলা দিয়ে ধান ঝাড়া এযেন এক বিরল দৃশ্য।

গাঁয়ের প্রকৃতিকে আরও প্রানবন্ত জীবনদান করে কৃষাণীদের কুলা দিয়ে ধান ঝাড়ার দৃশ্য।   রাস্তার পাশে ধান আর কুলোর ঝনত ঝনত শব্দ মনে এক প্রশান্তির আলিঙ্গন তৈরি করে।

জানা যায়, কুলোর উপর বিভিন্ন দানা শস্য নিয়ে কুলোর কিনারার বক্র অংশটি ধরে উপর নিচে ঝাঁকানো হয়। ফলে কানাবিহীন অংশটি, যা ধরে থাকা অংশ থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে, সেই অংশের গতি সবচেয়ে বেশি হয়। চাল ও খোসার মিশ্রণ একবার হাওয়ায় লুফলে ভারী চাল তারাতাড়ি নিচে পড়ে, কিন্তু হাল্কা ধানের খোসা বাতাসের রোধের ফলে ধীরে পরে ও চালের উপরে আলাদা স্তর তৈরি করে যা সহজেই আলাদা করে কানাবিহীন অংশ দিয়ে ফেলে দেওয়া যায়।

জেলার হোসেনপুর, বাজিতপুর এবং কটিয়াদিসহ বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায় ১শ থেকে ১শ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে কুলা।

জেলার হোসেনপুর উপজেলার বাঁশ-বেতের নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কিম্বা কৃষি সরঞ্জাম তৈরির কারিগর ছন্দু মিয়া জানান,কুলা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র যুগ যুগ ধরে মানুষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে।তবে এখন এর চাহিদা একটু কমে আসছে কারণ বাজারে প্লাস্টিকের তৈরি কুলা পাওয়া যায়,যা গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার না হলেও ঐতিহ্যগত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করে।

হোসেনপুর উপজেলার সাহেবের চর গ্রামের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার শাকিল আহমেদের বাড়ীতে কুলা দিয়ে বাদাম ঝাড়তে দেখা যায় কয়েকজনকে, কুলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,যেহেতু আমি ইলেক্টো মেডিকেলে ডিপ্লোমা করছি তাই কুলা সম্পর্কে আমার জ্ঞান কম তবে পারিপার্শ্বিক শিক্ষায় জেনেছি, কুলা নিত্য প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থালি যন্ত্র এছাড়াও  ঐতিহ্যের ধারক বাহক। আবার আবর্জনা ফেলার কাজেও ব্যবহার করা যায়। কুলো ভেঙ্গে গেলে তাকে খাদ্য শস্য বাছবার কাজের বদলে এইসব কাজে ব্যবহার করা হয়, সেই থেকে “ছাই ফেলতে ভাঙা কুলা” বাগধারাটি এসেছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker