কিশোরগঞ্জ

শীত শুরুর প্রাথমিক যাত্রা চরাঞ্চলেই

‘‘হেমন্তের ঐ শিশির নাওয়া হিমেল হাওয়া
সেই নাচনে উঠল মেতে।
টইটুম্বুর ঝিলের জলে
ফাঁটা রোদের মানিক জ্বলে
চন্দ্র ঘুমায় গগন তলে
সাদা মেঘের আঁচল পেতে।’’

-আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় শীতের বার্তা এভাবেই দিয়েছেন।

শীত!শীত মনে হয় চর কিম্বা হাওরে প্রাথমিক টেস্ট করে,প্রকৃতিতে ডানা মেলে বিচড়নের।

কিশোরগঞ্জে হোসেনপুরে ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে বাজতে শুরু করেছে শীতের আগমনী বাদ্য।হেমন্তের ভোরে হালকা শীতের আলিঙ্গন প্রকৃতিকে করেছে মধুমাখা। ভোরের আকাশে ছড়িয়ে থাকে কুয়াশা। হিমেল আবেশে স্তব্ধ চরাচর। সুন্দর সকাল ও কুয়াশার চাদরে মুড়ে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। আর কুয়াশার প্রলাপে ঢেকে আছে আমাদের দৃষ্টিসীমা। ধান গাছের ডগায় আলগতে পা ফেলে নামছে কুয়াশা।আবার মফস্বলে নদী কিম্বা খালের পাড়ের লোকজনকে মৃদু ঠান্ডা বাতাসের দাপটে আগুন পোহাতেও দেখা গেছে রাতে বেলায়।

শুক্রবার (১১ নভেম্বর) কাকডাকা ভোরে দেখা মিলে, সাহেবের চরের ফসলের মাঠে ও ঘাসের ডগায় উঁকি দিচ্ছে মুক্তময় শিশির। শিশির জন্মেছে গাছের পাতায়, ঘাসের ডগায়, শস্যক্ষেত্রে। শিশির বিন্দু টুপ-টাপ শব্দ আর মৃদু শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। গাছের মাথার উপরে জমাটবদ্ধ মেঘের আদলে শীতের হাতছানি দিচ্ছে হিমেল বাতাস।ক্ষণবাদেই কুয়াশার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে কুয়াশায় চাদরে মোড়ানো মিষ্টি সূর্য। প্রকৃতির এই হিম শীতল বন্দনায় জানান দিচ্ছে ঋতু পরিবর্তনের খবর।শীত ঋতু আসতে ক্ষানিকটা সময় লাগলেও শ্বাস -প্রশ্বাস বিসর্জন দিচ্ছে শীতে তাই বোধহয় প্রকৃতিতে মৃদু বিচরণ শীত মামুর।

অন্যদিকে শহরে একটু শীত দেরিতে আসে। কিন্তু হেমন্তের এই সময়ে গ্রামীণ জনপদে টের পাওয়া যাচ্ছে শীতের আগমন। শীতকাল আসন্ন।

উপজেলার “সাহেবের চর” পুরাতন ব্রম্মপুত্রে আবৃত মনোরম গ্রাম।সকালের সোনা রাঙ্গা রোদ যেন বাড়িয়ে দিয়েছে মাঠের- পথের উজ্জ্বলতা। গ্রামের মাঠে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু সবুজ ধান।
সকালে গায়েঁর রাস্তায় হাঁটলে ভিজে যাচ্ছে ঘাসের ডগার শিশিরে পায়ের স্যান্ডেল,মাটির মিশ্রণে হয়ে যাচ্ছে চ্যাপচ্যাপা।
কৃষক লাল মিয়া ফকির ও জসিম উদ্দিন কে কাকডাকা ভোরে মরিচ ক্ষেত নিড়াচ্ছেন,গায়ে চাদর জড়ানো। তারা জানান,সকালে কুশায়ার আবরণে মাঠ-ঘাট ঢেকে থাকে শীত শীত অনূভুতি হয়।ক্ষেত নিড়ালে হাতে কুয়াশা ভেজা মাঠি লেগে থাকে।

উপজেলার সাহেবের চর (হাজীবাড়ী) এলাকায় মহসিন মোবাইল সার্ভিস হোমে গিয়ে শুনা যায়,চার-পাঁচজন গ্রাহক তাদের মোবাইল ফোন মেরামত করাতে দিয়ে মহা মশগুল শীত কেন্দ্রীক আলাপচারিতায়।গায়ে চাদর জড়িয়ে শীতের প্রস্তুতির গল্প করছে।শীতে কী পোষাকে শরিল ডাকবে! এবার আগে বাগেই শীতের জানান মিলছে।

শখের বসে মাছ শিকারি বাদল মিয়া ও আব্দুস সাত্তার স্থানীয় নদ ব্রম্মপুত্রে বর্শি দিয়া মাছ ধরেন তারা জানান,রাতে কিছুটা অনুভূতিতে আসে শীত প্রকৃতিতে আস্তে আস্তে যায়গা করে নিচ্ছে।

শীতের সকালের রূপ অন্য সব ঋতু থেকে সম্পূর্ণই আলাদা। হেমন্তের দিনগুলো শেষ না হতেই শীতবুড়ি এসে প্রকৃতিতে হাজির। কুয়াশা কন্যারাও নির্জন বন-মাঠ আর নদীর কূলজুড়ে ছাউনি ফেলতে শুরু করেছে। সূর্যের আলোয় সবুজ মাঠগুলোকে মনে হয় কে যেন মুক্তার দানা ছড়িয়ে রেখেছে। সেই দানাগুলো থেকে রামধনুর সাত রঙের আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ দৃশ্য দেখলে পরাণ জুড়িয়ে যায়। শর্ষের খেতগুলো কিছুদিন পর হলুদের সাগর হয়ে যাবে যেথায় হিমেল হাওয়া ঢেউ খেলবে প্রতিনিয়ত। মাঠে মাঠে থাকবে হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি। বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর ঢাকা থাকবে হলুদে চাদরে। প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখ জুড়াতে জুড়ি নেই সরিষা ফুলের। এই ফুল যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দেয় ভিন্ন মাত্রা, ঠিক কৃষকের মনে জাগায় স্বপ্ন। এ ছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, টমেটো, লাউ, মুলা, কুমড়া, লালশাক, পালংশাক, বেগুন, শসা, মিষ্টিকুমড়ার খেতগুলো দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। এসব হাটবাজার থেকে লোকজনরা ব্যাগভর্তি করে শীতের সবজি নিয়ে বাসায় ফেরবে। এত সব পুষ্টিকর শাকসবজির পসরা অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না, বলছি পূর্ণাঙ্গ শীতের দখলের কথা।

ভোরে উপজেলার পৌর এলাকার কুঁড়ি ঘাট গিয়ে দেখা যায় শ্রমিক হাঁটে, শতাধিক শ্রমিক দৈনিক কাজের প্রত্যাশায় কারো হাতে কাঁচি, নিড়ানি কারও হাতে কোদাল-খাচি,পরণে লুঙ্গি, গলায় গামছা আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত লুঙ্গিও নিয়ছেন সাথে।তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলি, জানতে চাইলে তারা বলেন, “অহন সহালে মেলা শীত লাগে,শীত আইলে তু আমরা গরিবরার জ্বালা,জামার অভাবে নিজেও ভুগি শীতে,পোলাইনসহ কষ্ট করে,সহালে অনেক সমো কাম ধরতে পারি না। ওশ(কুয়াশা) পরে দেইখা। গাড়ী পাইনা কামলার আডো আইতাম।”

সাংবাদিক ও অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ বলেন,হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে আসে শীত। শীতের কথা স্মরণ করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে কুয়াশার চাদরে ঢাকা চারপাশ। হিমেল বাতাসে কাঁপতে থাকে শীতার্ত মানুষজন। সারি সারি খেজুরগাছে ঝুলতে থাকা রসের ভাঁড়। সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত রসের ভাঁড়ে মৌমাছিদের নৃত্য। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর নয়নাভিরাম দৃশ্য। এটা শীত ঋতুর একটা সাধারণ চিত্র। প্রকৃতিতে আচঁ করা যাচ্ছে শীতের আগমন ঘটতে চলেছে।

হোসেনপুরের সিদলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন বলেন,এ ঋতু ফুল-ফসলে সমৃদ্ধ। তাই শীতকাল অন্য সব ঋতু থেকে আলাদা গুরুত্ব পেয়ে থাকে। বাংলার রূপবৈচিত্র্যের অনেকখানি জায়গাজুড়ে শীতের অবস্থান।শীত ঋতু আসন্ন থাকলেও শীতের শীতল আবহাওয়া রাতে প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। অবশ্য দুপুরে রুদ্রের প্রখরতা কিছুটা মন্থর হলেও টকবগিয়ে ঝাঁঝ।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker