কিশোরগঞ্জের ইটনায় বোরো ধান ঘরে তোলার আগেই উপজেলার কয়েকশ কৃষকের কাঁচা ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। ইটনা হাওরের মাঠে মাঠে এখন কৃষকদের হাহাকার চলছে। চোখের সামনে শত শত বিঘার ফসল পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। সেই ফসলের কিছুটা ঘরে তুলতে আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন কৃষকরা। নৌকা নিয়ে তলিয়ে যাওয়া সেই ধানগুলো কেটে আনতে চেষ্টা করছেন তারা।
জানা যায়, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড় জেলার চেরাপুঞ্জি শহরে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। এতে নদীর পানি বেড়ে গেছে। সেই পানি প্রবল বেগে সুনামগঞ্জে ঢুকছে। এরপর নদী দিয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা হাওরে প্রবেশ করছে।
ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রাম। হাওর এলাকার এই গ্রামটিতে একটি জমির পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, কোমর পানিতে নেমে ধান কাটছেন কৃষক ফাইজুল ইসলাম। আর তার ৮ ও ১০ বছরের দুই ছেলে এবং ৬ বছরের মেয়েটি ধানের মুঠি টেনে টেনে জড়ো করছে। শ্রমিক সংকটে বাবার কাজে সহযোগী হয়েছে তারা।
ফাইজুল জানান, এই ফসলের ওপর নির্ভর করে তার সারা বছরের খোরাক। খোরাকের পর যে ধান থাকে সেগুলো বিক্রি করে চালান সন্তানদের পড়াশোনা, চিকিৎসা আর অন্যান্য খরচ। ‘কিন্তু এবার সব গেল’ বলেই চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে গেলেন জমিতে।
হাতে গোনা আর মাত্র কয়েকটা দিন পরই পেকে যেত সব ধান। সোনার ফসল ঘরে তুলতেন কৃষকরা। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের পানি এসে ঢুকতে শুরু করেছে কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে। ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আনুমানিক ২০০ একর জমির ধান স্থানীয়দের মতে। বিভিন্ন খাল ও নদী তীরবর্তী জমিগুলোর বেশির ভাগই ডুবে গেছে।
এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে আধাপাকা ধানই কাটতে শুরু করেছেন হতবিহ্বল কিছু কৃষক। আর এই ধান কাটতে কেউ কেউ নামছেন কোমর, এমনকি গলা পানিতেও।
জমিতে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় ধান কাটার শ্রমিকও মিলছে না। বাধ্য হয়ে তাই পরিবারের ছোট-বড় সদস্যরাই কাঁচি হাতে নেমে গেছেন নিজেদের জমিতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পানির নিচে প্রায় তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে মুঠিগুলো ছোট ছোট নৌকা কিংবা ত্রিপলের ওপর জমা করছেন কৃষকরা। পরে সেগুলো টেনে তুলছেন ট্রলিতে। নেয়া হচ্ছে ধানের খলায়। কিন্তু এত শ্রম আর বাড়তি খরচ করে আধাপাকা ধানে শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হবে কি না তা জানা নেই কারও। কৃষকের চোখে-মুখে তাই এখন হতাশার ছাপ।
স্থানীয় কৃষক আবুল হাসিম বলেন, ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জমিতে ধান লাগিয়েছি। সেই জমিগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। যে ধানগুলো তলিয়ে গেছে তা এখনও পাকেনি। তাই কাঁচা ধান কাটতে চেষ্টা করছি।
কৃষক সমির আলী জানান, এখনও ধান কাটার মতো অবস্থা হয়নি। হঠাৎ করে পানি আসায় ধান তালিয়ে গেছে। তাই সকাল থেকে শ্রমিক নিয়ে কাঁচা ধানই কাটার চেষ্টা করতেছি। পাশাপাশি এলাকার লোকজন নিয়ে বাঁধ মেরামতেরও কাজ চলছে।
ইটনা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান শফিকুল ইসলাম সোহাগ বলেন, পানি হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ফসল রক্ষা বাঁধে কিছুটা ফাটল দেখা দিয়েছে। তাই এলাকার লোকজন নিয়ে আমরা নিজেরাই বাঁধ মেরামত করছি।
ইটনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উজ্জল সাহা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে আসা তথ্যমতে উপজেলার বাদলা হাওর, সদর ইউনিয়নের এরশাদনগর, আলালের বন, ধনপুর, বেতেগাসহ এলংজুরী ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকেছে।’
জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ইটনা উপজেলার হাওরের প্রায় ২০০ একর জমির বোরো ধান পানিতে নষ্ট হয়েছে। তবে এখনও
বিস্তীর্ণ হাওরে পানি প্রবেশ না করলেও পানিতে তলিয়ে গেছে নদীর পারের চরাঞ্চলের ফসলগুলো।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সাইফুল ইসলাম আলামিন জানান, ইটনা উপজেলায় আনুমানিক ২০০ একর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই ধান চাষিরা কাটছে। ধানগুলোর প্রায় ৮০ ভাগ পেকে গেছে। ইটনাসহ কিশোরগঞ্জে তিনটি হাওর উপজেলায় এবার ১ লাখ ৪ হাজার মেট্রিকটন বোরো ধান আবাদ হয়েছে।