প্রকৃতির শক্ত ভিতে তৈরি গাছ তালগাছ। ঘূর্নিঝড়, টর্নেডো, আইলা, নার্গিস, ফনি কিংবা সিডর অথবা অন্যান্য পৃথিবী কম্পনশীল ঝড়ো হাওয়াতেও নিজেকে স্ববলে টিকিয়ে রাখার গাছটিই প্রকৃতির বাহাদুর বৃক্ষ তালগাছ। নিপুণ কারিগর যাকে বলা চলে “উন্মুক্ত ছাফরবন” সেই চিরচেনা বাবুই পাখিও পরিবেশ থেকে বিতাড়িত, বনখেকো মানুষজনের তাল গাছের প্রতি অনাদর, অযত্ন, জল্লাদী আচরণে।তালগাছের বিভাজন সঙ্গে বিয়োগ সমাধি রচনা করেছে বাবুই পাখির।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থেকে প্রায় বিলুপ্তির পথে পরিবেশ বান্ধব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী এই গাছ। একইসঙ্গে জীবজগতে প্রকৌশলী নামে খ্যাত বাবুই পাখিও আজ হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন উপজেলার গ্রামাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাল গাছের দেখা মিললেও এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অবাধে তাল গাছ নিধন করায় এ উপজেলায় তাল গাছ শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে নেই বাবুই পাখির দৃষ্টিনন্দন বাসা ও বাবুই পাখি। পড়ন্ত বিকেলে তালগাছে মনের মাধুরি দিয়ে তৈরি করা বাবুই বাসা, যাতে অনিন্দ্য বাবুইদের কর্মব্যস্ততা অবিরাম আনাগোনা এখন যেন শুধুই স্মৃতি।
পরিবেশ বিদদের ভাষ্য মতে, অবাধে তাল গাছ নিধনের কারণে ঝড়, বৃষ্টি ও বিজলী (বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের) হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, পশু-পাখিসহ জীব বৈচিত্র। গত বছর বিজলী পড়ে হোসেনপুরে বেশ কয়েকজন মারা গেছেন।
সাংবাদিক আশরাফ আহমেদ এর বর্ণনায়, হোসেনপুর উপজেলায় ছয়টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভাসহ বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে প্রচুর তাল গাছ ছিল। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ও রাস্তার ধারে পুকুর পাড়ে ছোট বড় অনেক তাল গাছ শোভা পেত। ভাদ্র মাসে গাছে গাছে ভরা থাকতো তাল। অধিকাংশ গাছের পাকা তাল ঝরে পড়ে। গ্রামের মানুষ কুড়িঁয়ে পাওয়া তালের রস দিয়ে তৈরি করে সুস্বাদু পিঠা।
তালের পাতা দিয়ে তৈরি হতো নানা কারুকার্যের হাতপাখা। গরমকালে তাল পাতার পাখার কদর ছিল সবার কাছে। কিন্তু তাল গাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় যে বিশাল ভূমিকা আছে এবং পরিবেশবান্ধব তালের উপকার সম্পর্কে না জানায় তাল গাছ ইট ভাটায় লাকড়ি, ঘরের পাইরসহ নানা কাজে ব্যবহারের জন্য নির্বিচারে কেটে ফেলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ তাল গাছ কাটা হয়ে গেছে।
উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের মরতুজা আলী, লিটন মিয়া, নাজিমুদ্দিন বলেন, উপজেলায় বাইরে থেকে আসা গাছ ব্যাপারীরা প্রতি গাছ তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় কিনে নেয়। কিন্তু নতুন করে গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগ নাই। এ কারণে দিন দিন প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েসের মতানুসারে, তাল গাছ প্রকৃতির বন্ধু ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী বৃক্ষ। এ গাছ প্রবল ঝড় বৃষ্টি ও আকাশের বিজলী থেকে মানুষ ও প্রাণী জগতকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। ফলে যেসব এলাকায় তাল গাছের সংখ্যা বেশি সেসব এলাকায় ঝড়ে ও বিজলীতে মানুষ ও পশু পাখির মৃত্যুর হার খুব কম।
আরো বলেন, প্রকৃতির জীব বৈচিত্র রক্ষায় সরকার বাড়ির আঙিনার পাশে, রাস্তার ধারে ব্যাপকভাবে তাল গাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে নিজেকে ও এলাকাকে রক্ষার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও তাল গাছ রোপণের আহ্বান জানান তিনি।
অন্যদিকে উপজেলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য জরুরি ভিত্তিতে তাল গাছ রোপণের দাবি জানিয়েছেন পরিবেশ বিদরা।