স্বাস্থ্য

ঝিঙে জনপ্রিয় একটি সবজি: ঔষধি গুণে ভরপুর

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল। সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে-কুল – ঝিঙে ফুল। গুল্মে পর্ণে লতিকার কর্ণে ঢলঢল স্বর্ণে ঝলমল দোলো দুল – ঝিঙে ফুল॥

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “ঝিঙে ফুল” কবিতা কার না মনে শিহরণ জাগিয়েছে!

ঝিঙ্গে বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সবজি। কিশোরগঞ্জে খুব যত্ন সহকারে কৃষক ফলিয়ে থাকেন ঝিঙে। নরম শরিলীয় সবুজীয় গাছ,হলদে ফুল আকৃষ্ট করে প্রকৃতি প্রেমী মন। ঝিঙে সবজি হিসাবে খাবারের জন্য কচি অবস্থায় সংগ্রহ করা হয়। এই সবজি চীন ও ভিয়েতনামের অতি জনপ্রিয়।

ঝিঙ্গা হলো বর্ষজীবী লতাগাছ, গাছের মসৃণ গাঁট থেকে নতুন কান্ড বের হয় ও পরিনত সময়ে ফুল ও ফল হয়। সাধারনত লতাটি বেড়ায় গায়ে, মাচায় ও অন্য গাছকে আশ্রয় করে প্রসারিত হয়ে থাকে। লাউ কুমড়োর মত ঝিঙ্গারও দুই রকমের ফুল হয়। এর ফুল হলুদ রঙের হয়ে থাকে। সন্ধ্যার আগে ফুল ফোটে। সবুজ রঙের সব্জি বোঁটার দিক থেকে চিকন হয়ে আস্তে আস্তে মোটা হতে থাকে এবং সব্জিটি দেখতে শিরসম্পন্ন, এজন্য এর নাম ধারা কোষাতকী। সবজির ভিতরে প্রকোষ্ঠগুলি দেখতে যেন জাল বুনে তৈরী, সেটা দেখা যায় ফল পাকলে। প্রকোষ্ঠের মধ্যে অনেকগুলি বীজ থাকে। এগুলি দেখতে অনেকটা ডিম্বাকৃতি ও চেপ্টা।

জানা যায়,ঝিঙ্গার বৈজ্ঞানিক নামঃLuffinea,ঝিঙ্গার ইংরেজি নামঃLuffa,ঝিঙ্গার খাদ্য উপাদানঃঝিংগায় রিবোফ্ল্যাভিন, জিঙ্ক, লোহা, থায়ামিন, ম্যাগনেশিয়াম ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়াম রয়েছে।

আরো জানা যায়, ১০০ গ্রাম ঝিঙ্গায় আছেঃ
প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য অংশের মধ্যে রয়েছে ০.৫ গ্রাম প্রোটিন, ৩৩.৬ মাইক্রো গ্রাম বিটা-ক্যারোটিন, ৫ মিগ্রা ভিটামিন সি, ১৮ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ২৭ মিলিগ্রাম ফসফরাস।

সাধনা মুখোপাধ্যায়ের সুস্থ থাকতে খাওয়া দাওয়ায়
শাকসবজি মশলাপাতি বইয়ে ১১৪-১১৬ পৃষ্ঠায় ঝিঙ্গার ঔষধি গুনগুন উল্লেখ করা আছে:

১. ঝিঙে সবজি শীতল মধুর খাবার। পেটের খিদে বাড়ায়, হাপানি জ্বর, কাশি, বমি উপশম করে। পেট পরিস্কার করে দেহকে সুস্থ রাখে।

২. ঝিঙা খাবার গ্রহণের ফলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে।

৩. ভিটামিন সি রক্তের বিশুদ্ধতা চামড়ার সৌন্দর্য, চর্মরোগ, দাঁতের মাড়ি নানা রোগ ও এন্টিঅক্সিডেন্টকে শক্তিশালী করে।

৪. ঝিঙাতে থাকা ফোলেট হৃদরোগ বা হার্ট অ্যটাক প্রতিরোধ করে।

৫. ঝিঙায় আঁশ থাকায় সহজে হজম হয় এবং কোষ্টকঠিন্য দূর করে।

৬. যারা গ্যাষ্টিকে ভ‚গছেন তারা ঝিঙে খান উপকার পাবেন। ঝিঙাতে ভিটামিন ই থাকা এটি শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।

৭. রক্তের বিদ্যমান এলডিএল লো-ডেনসিটি লাইপ্রোটিন) নামের একপ্রকার ক্ষতিকর কোলেস্টরলের মাত্রা কমায়। হৃদরোগ ও ষ্টোকের জন্য দায়ী রক্তনালীতে এথোরোস্কেলেরোসিস প্রতিরোধ করে।

৮.মহিলাদের সন্তান ধারণ ক্ষমতা ও পুরুষের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৯.শরীরে বয়সের চাপ পড়তে দেয় না। ফলে তারুণ্য বজায় থাকে।

১০. তেতো ঝিঙে কৃমি ও অর্শ রোগে বেশ উপকার সাধন করে।

১১.শরীরের কোনো অংশে ঘা হলে তেতো ঝিঙের রস লাগালে ঘা কমে যাবে।

ঝিঙের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াঃ

ঝিঙের খুব বেশি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া না থাকলেও প্রত্যেকটি খাদ্য উপাদান ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার পরিমাণটা মাথায় রেখে ব্যবহার করতে হবে। একনাগাড়ে এবং বেশি পরিমাণে যদি কোনও খাদ্য উপাদান ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে ঝিঙের ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকলেও সামান্য কয়েকটি দেখা গিয়েছে।

গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে ঝিঙে খাদ্য তালিকায় রাখা নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয় না। তাই গর্ভাবস্থায় ঝিঙে খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

অনেকের ক্ষেত্রে ঝিঙে খাওয়ার ফলে এলার্জির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, সে ক্ষেত্রে ঝিঙে খেলে যদি এলার্জির সম্ভবনা হয় তবে ঝিঙে খাওয়া বন্ধ করে দিন।

ঝিঙের স্বাদ খুব বেশি ভালো না হলেও এটি আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় একটি সবজি। যদি সরাসরি ঝিঙে সবজি হিসেবে খেতে ইচ্ছা না করে সে ক্ষেত্রে ঝিঙের রস খেতে পারেন। তবে ঝিঙে থেকে যদি কোনও প্রকারের এলার্জি দেখা যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ তা খাওয়া বন্ধ করে দেবেন এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার প্রতিটি উপজেলায় বিশেষ করে গ্রামের প্রায়শই বাড়িতে দু-চারটা শখের ঝিঙে গাছ দেখা মিলে,যা বাড়ির মহিলাদের পরিচর্যায় বেড়ে উঠে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের কৃষক আশরাফুল ইসলাম তিনি তিন কাঠা জমিতে ঝিঙে চাষ করেছেন তিনি জানান, ঝিঙ্গা চাষে সেচ ও নিকাশের উত্তম সুবিধাযুক্ত এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক প্রায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। একই গাছের শিকড় বৃদ্ধির জন্য জমি এবং গর্ত উত্তমরুপে তৈরি করতে হয়। এ জন্য জমিকে প্রথমে ভাল ভাবে চাষ ও মই দিয়ে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন জমিতে কোন বড় ঢিলা এবং আগাছা না থাকে।

মিন্টু হাসান, আলতাফ হোসেন, মসহিন আহমেদ হকসহ অনেকেই জানান, বাড়ির আঙ্গিনায় ৮/১০টা ঝিঙের বীজ রোপন করলে, মোটামুটি খাদ্য তালিকায় ঝিঙের গ্রহণযুগ্যতা থাকে। এর পুরোটা ক্রেডিট বাড়ির গৃহিণীদের। আমাদের অঞ্চলের নারীরা মৌসুমে বাড়ির আঙ্গিনায় বিভিন্ন সবজি ক্ষদ্র পরিসরে চাষ করে পাশাপাশি ঝিঙেও থাকে।

হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক আশরাফ আহমেদ বলেন, ঝিংগার ফুল বিকালে ফোটে। বিকাল ৪ঃ০০ সন্ধ্যার মধ্যে ফুল ফোটা শেষ হয়। এর পরাগায়ন ফুল ফোটার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এবং পরদিন সকালের অগ্রভাগে হয়। ঝিঙ্গার কৃত্রিম পরাগায়নে ভাল ফলন পাওয়া যায়। কৃত্রিম পরাগায়নের নিয়ম হলো ফুল ফোটার পর পুরুষ ফুল ছিড়েঁ নিয়ে ফুলের পাপড়ি অপসারণ করা হয় এবং ফলের পরাগধানী (যার মধ্যে পরাগরেণু থাকে) আস্তে করে স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ডে (যেটি গর্ভাশয়ের পিছনে পাপড়ির মাঝখানে থাকে) ঘষে দেয়া হয়। অন্যান্য সবজির তুলনায় ঝিঙে আমাদের অঞ্চলে কম লক্ষ্য করা যায়।

কৃষির সাথে সম্পৃক্ত হোসেনপুর উপজেলার সিদলা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃসিরাজ উদ্দিন বলেন, ঝিংগা একটি গ্রীষ্মকালীন উপাদেয় সবজি। তবে এটি গ্রীষ্ম ও বর্ষা উভয় মৌসুমে চাষ করা হয়। ঝিংগায় প্রচুর পরিমান ক্যারোটিন ও ক্যালসিয়াম রয়েছে।অন্যান্য সবজির মত উপযুক্ত মতে ঝিঙে চাষ করে অধিক মুনাফা অর্জন সম্ভব।

এআইএস তত্ত্বমতে,ভালো জাত উর্বর মাটিতে উত্তমরুপে চাষ করতে পারলে হেক্টর প্রতি ১০-১৫ টন (শতাংশ প্রতি ৪০-৬০ কেজি ) ফলন পাওয়া সম্ভব।

Author


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker