কিশোরগঞ্জ

কিশোরগঞ্জে আড়াল হতে চলেছে মাথাল

মাহফুজ হাসান, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি

রোদ-বৃষ্টিতে করে চাষ মাথালও মাথায়,
এ যে মোদের খাঁটি মানুষ সোনার কৃষক ভাই।

কবিতার এ পঙ্কতিদ্বয়ের সেই আলাভোলা আবেগের দেশীয় ঐতিহ্য মাথাল আজ কিশোরগঞ্জে বিলুপ্তির দ্বার প্রান্তে।  বাংলার কৃষি, কৃষক আর মাথাল যেন একসূত্রে বাঁধা। সনাতন প্রথার কৃষিকাজে কৃষকের এক অপরিহার্য কৃষি উপকরণ হলো মাথাল। রোদ-বৃষ্টিতে কৃষকদের সারাদিন মাঠে কাজ করতে হয়। মাঠে সাধারণত কোনো আশ্রয় বা ছায়া দেয়া গাছ থাকে না। কৃষকদের কাজ করতে হয় দু’হাতে। তাই ছাতা হাতে ধরে ক্ষেতে কাজ করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকরা নিজস্ব কৃৎকৌশলে ছাতার মতো একটি উপকরণ তৈরি করে নিয়েছে, যার নাম মাথাল বা মাতলা।

জানা যায়, মাথাকে রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য এটি ব্যবহার হয় বলে এর নাম মাথাল। প্রাচীনকালে ছাতার ব্যবহার ছিল না। তাই তখন বর্ষাবাদলের দিনে গ্রামীণ লোকেরা মাথাল ব্যবহার করত। এমনকি শূকর চারণকারী টাওরা সম্প্রদায়ের লোকেরাও শূকরের পাল চরানোর সময় ঢাউস আকারের বৃহৎ মাথাল ব্যবহার করে।

কিন্তু বর্তমানে হাওর অঞ্চলে কিছুটা লক্ষ্য করা গেলেও  কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় এর ব্যবহার নেই বললেই চলে।

আরও জানা যায়, এলাকাভেদে মাথালের বিভিন্ন নাম রয়েছে। তৈরির উপকরণ ও ব্যবহারের পার্থক্য থাকায় নামেরও পার্থক্য এসেছে। যেমন গাজীপুর অঞ্চল ও ঢাকায় মাথালকে বলা হয় ‘মাতলা’ বা ‘পাতলা’। কেননা, এ অঞ্চলে মাথাল তৈরিতে গজারি গাছের পাতা ব্যবহার করা হয়। দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে ব্যবহার করা হয় শাল বা সেগুনের পাতা। ময়মনসিংহ ও জামালপুর অঞ্চলে মাথাল বানানো হয় কাঁঠালপাতা দিয়ে। রাজশাহী তথা বরেন্দ্র এলাকায় এটা বানানো হয় তালপাতা দিয়ে। বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলে বানানো হয় হোগলাপাতা দিয়ে। বাঁশের চটা বা কাঠির সাহায্যে বুনে শুকনো পাতা দিয়ে এটা বানানো হয় বলে কিশোরগঞ্জে তাকে বলা হয় পাতলা। কোথাও কোথাও এর নাম টুকি, টোকা, টোপর ইত্যাদি। রংপুর অঞ্চলে মাথালকে বলে ঝাঁপি। যারা ঝুড়ি, ডালা ইত্যাদি বানায় তারাই মাথাল বানিয়ে বিক্রি করে। কৃষকরা হাটবাজার থেকে কিনে সেগুলো ব্যবহার করে।

বহির্বিশ্বেও এর ব্যবহার আছে ঢাকা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে , কম্বোডিয়ায় একে ডৌন বলা হয়। লাওসে কৌপ বলা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় সেরাং বলা হয়। থাইল্যান্ডে নগুপ  বলা হয়। মিয়ানমারে এটিকে খামাউক বলা হয়। ফিলিপাইনে একে সালাকোটবলা হয়। ভিয়েতনামে একে নোন লা  বলা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায়, আসামে এটি জাপি নামে পরিচিত এবং বাংলাদেশে এটি মাথাল নামে পরিচিত।

মাথালের গড়নগত একটা বিশেষত্ব আছে। মাঝখানটা পিরামিড বা শম্বুকাকার। এ অংশটি মাথার মধ্যে বসে যায়। এর চারধারে বৃত্তাকারে থাকে ছাঁট বা কার্নিশ- অনেকটা ঘরের বারান্দার চালের মতো। মাথালকে মাথার সাথে শক্তভাবে এঁটে রাখার জন্য রশি থাকে দু’পাশ থেকে। মুখের নিচে থুতনির সাথে তা বেঁধে দেয়া হয়। মাথাল পানি প্রতিরোধী হওয়ায় তা পরে বর্ষার দিনেও কৃষকরা মাঠে স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারে। শুধু কৃষিকাজে নয়, মাথাল গম্ভীরা গানের শিল্পীদেরও এক গুরুত্বপূর্ণ সাজ উপকরণ। বরগুনা ও পটুয়াখালীর কৃষকরা হোগলা পাতা দিয়ে বানানো অন্য আর একধরনের মাথাল ব্যবহার করে। বর্ষাকালে সেটি ব্যবহার হয়। তাকে বলে ‘জোংড়া’। এটি শুধু মাথা নয়, পিঠও বর্ষার হাত থেকে রক্ষা করে।

জেলার হোসেনপুর উপজেলার কৃষক সায়াম উদ্দিন(৮০)জানান,আগে পাতলা ব্যবহার হতো অনেক বেশি কারণ সারাক্ষণ রোদ বৃষ্টিতে কাজ করলে এর বিকল্প ছিলনা বর্তমানে কৃষকরা রোদ-বৃষ্টিতে সারাক্ষণ কাজ কমই করে,মেশিনে চাষ করার ফলে ইটা মুগুর ব্যবহার করতে হয় না। স্প্রে দ্বারা ঘাস নিধনের ফলে খেত নিড়াতে হয়না।

কৃষক সূতি মিয়া (৭৫) জানান, এখন কৃষকরা পাঠ, মরিচ, কলাই, আউস ধান, শরিষা ইত্যাদি ফসল কম চাষ করে যার জন্য সারাদিন একটানা কাজ করতে হয়না তাই পাতলার ব্যবহারও কম।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker