টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলবাসীর বোবা কান্নার ২৮ বছর

দেখতে দেখতে কেটে গেছে ২৮ বছর। তবুও চোখের পলক ফেললে মনে হয় এই তো সেদিন। ১৯৯৬ সালের ১৩ মে বিকালের ভয়ার্ত স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। এত বছর পরও টাঙ্গাইলের মানুষ ভুলতে পারেনি ভয়াল ১৩ মে’র টর্নেডোর সেই তান্ডবের স্মৃতি।

এ দিনটি টাঙ্গাইলবাসীর জন্য শোক ও আতঙ্কের দিন। সোয়া দুই যুগেও কাটেনি সেই আতঙ্ক। এখনও স্মৃতি রোমন্থন বা ঘুমের ঘোরে আৎকে (শিউরে) ওঠে জেলার পাঁচ উপজেলার মানুষ। ২৮ বছর আগে ১৯৯৬ সালের এই দিনে মাত্র প্রায় পাঁচ মিনিট স্থায়ী টর্নেডোর ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলায় জেলার ৫২৩ জন নারী-পুরুষ নিহত ও ৩০ হাজার আহত হন। টর্নেডোর ছোবলে ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি, ৮৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১৭টি মসজিদ এবং ১৪টি মন্দির লন্ডভন্ড হয়ে যায়। সেদিনের কথা মনে হলে এখনও আতঙ্কে শিউরে উঠে স্থানীয় মানুষজন।

সেদিন বিকালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে মুহুর্তের মধ্যে জেলার গোপালপুর, কালিহাতী, বাসাইল, ঘাটাইল ও সখীপুর এ পাঁচটি উপজেলার ৪০টি গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। অনেকের ঘরের চালা উড়ে যাওয়ায় গোলার ধান ঝড়ে অদৃশ্য হতে দেখা যায়। অনেক ঘরবাড়ি, গাছপালা, গবাধিপশু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অনেক নারী-পুরুষের পড়নের কাপড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অনেককে সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন ক্ষতবিক্ষত দেহে বিভিন্ন কৃষি জমি, জঙ্গল, পুকুর-ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয়। বৈদ্যুতিক খুঁটি ও নলকূপের ওপরের অংশ দোতলা দালানের ছাদ পর্যন্ত উঠে যায়।

Image

জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ১৩ মে ছিল সোমবার। বিকাল ৪টা ১৭ মিনিটের দিকে আকস্মিকভাবে গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ইউনিয়নের বেলুয়া গ্রাম থেকে শুরু হওয়া প্রায় পাঁচ মিনিট স্থায়ী প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় (টর্নেডো) আলমনগর ইউনিয়ন হয়ে মির্জাপুর ইউনিয়নের পশ্চিম নুঠুরচর গ্রামে হানা দেয়। মাত্র দুই মিনিটের ছোবলে গোপালপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৬টি গ্রাম লন্ডভন্ড হয়ে যায়। নিহত হয় ১০৪ নারী-পুরুষ। এছাড়া চার হাজারেরও বেশি গ্রামবাসী আহত হয়। ঝড়ে ২০০ একর বোরো জমির পাকা ধান বিনষ্ট হয়ে যায়। ১০ হাজার গৃহপালিত পশু-পাখি মারা যায়। পরে টর্নেডো কালিহাতীতে হানা দেয়।

ওই দিনই বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে কালিহাতী উপজেলার তাঁতসমৃদ্ধ এলাকা রামপুর-কুকরাইল গ্রামে টর্নেডো আঘাত হানে। রামপুর ও কুকরাইল গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে ওই দুই গ্রামের একই পরিবারের ৭ জনসহ ১০৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত এবং চার শতাধিক মানুষ আহত হয়। রামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে গণকবরে একত্রে দাফন করা হয় ৭৭ জনের মরদেহ।

Image

বাসাইলের মিরিকপুরে ধান কাটার মৌসুম থাকায় উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ধানকাটা শ্রমিক সমবেত হয়েছিল এ অঞ্চলে। ঝড় থেকে রক্ষা পেতে মিরিকপুর-সৈদামপুরের ধান ক্ষেতের আতঙ্কগ্রস্ত বহু শ্রমিক মিরিকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল। সেদিন বিকাল পাঁচটা ২০ মিনিটের দিকে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা সল্প সময়ের টর্নেডোর ছোবলে স্কুলভবনটি বিধ্বস্ত হওয়ায় তারা সেখানেই চাপা পড়ে মারা যায়। গ্রামের বহু লোক নিখোঁজ হয়। পরদিন তাদের মৃতদেহের খোঁজ মেলে পাশের নদী, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয়ে। মৃত মানুষ, গবাদিপশু ও মাছের দুর্গন্ধে বাসাইলের বাতাস সেদিন ভারি হয়ে গিয়েছিল।

মিরিকপুর ছাড়াও ওই উপজেলার বর্নীকিশোরী, হান্দুলিপাড়া, কলিয়া, কাউলজানী, খাটরা, ফুলকী, বাদিয়াজান, সুন্না গ্রামের অংশবিশেষ টর্নেডোর ছোবলে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়। বর্নীকিশোরী উত্তরপাড়ার এক পরিবারের মরদেহ প্রায় আধমাইল দূরের বিল থেকে উদ্ধার করা হয়। অনেক পরিবারের কেউই জীবিত ছিল না। বাসাইল উপজেলা হাসপাতালসহ পাশের হাসপাতালগুলো ছিন্ন ভিন্ন আহত লোকজনে ভরে গিয়েছিল। উপজেলায় টর্নেডো আক্রান্ত এলাকায় একাধিক গণকবর তৈরি করা হয়েছিল।

ঘূর্ণিঝড়ে বাসাইল উপজেলার ১৭ গ্রামের পাঁচ হাজার পরিবারের প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ২০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫-৬টি কাঁচাবাজার, প্রায় দুই হাজার গবাদিপশু, ১০ হাজার হাঁস-মুরগি, সাড়ে ৩০০ টিউবওয়েল ও ২৫ হাজার গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ২৩৭ জনে দাঁড়ায়। তবে বেসরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ছিল আরও অনেক বেশি।

আজও আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা দেখলে বাসাইলের মানুষের মনে ভেসে ওঠে মিরিকপুরের সেই ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্কিত স্মৃতি। টাঙ্গাইলের ৪০টি গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সেদিনের টর্নেডোর আঘাতে মারা যায় অসংখ্য গবাদি পশু, দুমরে-মুচড়ে যায় ঘরবাড়ি, বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয় ফসলের মাঠ। সেই পাঁচ মিনিটের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় (টর্নেডো) টাঙ্গাইল জেলার বৃহদাংশের সবকিছু ধ্বংস করে দেয়। ওই সময় বিভিন্ন সমাজ সেবামূলক সংগঠন  ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে এগিয়ে আসেন।

সেদিনের টর্নেডোর আঘাতে অনেকেই পঙ্গুত্বকে বরণ করে আজও বেঁচে আছেন। টর্নেডোয় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্মরণে স্ব স্ব এলাকায় স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে প্রতিবছর দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এই দিনটিকে স্বরণ করে কালিহাতীর রামপুর-কুকরাইল গ্রামের স্বজন হারানো পরিবারগুলো প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কাঙালি ভোজ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। মসজিদে মসজিদে করা হবে বিশেষ মোনাজাত।


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

আব্দুস সাত্তার, বিশেষ প্রতিনিধি

নাম আব্দুস সাত্তার। তিনি পেশায় একজন সাংবাদিক। তিনি মিশন নাইনটি নিউজের একজন বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত আছেন।

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker