শিক্ষা

অভাব দমাতে পারেনি ওদের

স্কুলে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিল যশোরের শার্শার মিফতাহুল জান্নাত নিপা। পা হারিয়েও মনোবল হারায়নি সে। অভাবের কারণে সাময়িকভাবে মাদরাসা ছাড়তে হয়েছিল আখাউড়ার সুরাইয়াকে। কুড়িগ্রামের কৌশিক আর ধামইরহাটের আরাফাতের নিরন্তর সংগ্রামও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে।

কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় ওরা সবাই পেয়েছে জিপিএ ৫। তাদের জীবনযুদ্ধ জয়ের কাহিনি।

দুর্ঘটনায় পা হারানো নিপা

সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানো যশোরের শার্শার মিফতাহুল জান্নাত নিপা এবার এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখা জান্নাতের এমন সাফল্যে উচ্ছ্বসিত পরিবারের সদস্য ও শিক্ষকরা।

নিপা শার্শা উপজেলার নাভারণ দক্ষিণ বুরুজবাগান গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে। বুরুজবাগান পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল সে।

২০১৯ সালের ২০ মার্চ ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে চড়ে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল নিপা। তখন সে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী।

একটি পিকআপ ভ্যান নিপাকে বহনকারী ইঞ্জিনচালিত ভ্যানটিকে ধাক্কা দেয়। এতে নিপা সড়কে ছিটকে পড়ে। পিকআপ ভ্যানটির চালক তার শরীরের ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেন। গুরুতর আহত নিপাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তার ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দেন। এর মাত্র তিন দিন পর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ফল ঘোষিত হলে দেখা যায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে নিপা।

কিন্তু সেদিন বৃত্তি পাওয়ার খবরেও সে আনন্দ করতে পারেনি।

চিকিৎসা শেষে এক পায়ের ওপর ভর করেই চলতে অভ্যাস করেছে নিপা। চালিয়ে গেছে লেখাপড়া। তার বাবা রফিকুল ইসলাম একটি প্রি-ক্যাডেট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। দুর্ঘটনার পর তিনি জমি বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে ভারতের ভেলোরে যান। সেখানকার হাসপাতালে সাড়ে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে তার কৃত্রিম পা লাগানো হয়। মেয়ের চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ভারতে থাকায় চাকরি চলে যায় নিপার বাবার। পরে বুরুজবাগান পাইলট বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বাবাকে কিছুটা সহায়তা করতে সীমিত বেতনে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওই বেতন এবং টিউশনির নগণ্য আয় দিয়ে রফিকুল ইসলাম সংসার চালানোর পাশাপাশি দুই সন্তানকে লেখাপড়া করাতেন।

ফলাফলের ব্যাপারে নিপা বলল, ‘জিপিএ ৫ পাওয়ায় আমি খুব খুশি। আমি ডাক্তার হতে চাই। যত কষ্ট হোক, ভালো করে লেখাপড়া করে আমি ডাক্তার হব।’

নিপার বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার খুব সামান্য আয়। তা দিয়েই ওকে আমি লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছি। ও ডাক্তার হতে চায়। যত কষ্টই হোক, ওকে আমি শেষ পর্যন্ত পড়িয়ে যাব।’

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘নিপা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। আর এত বড় একটা দুর্ঘটনার পরও সে মনোবল হারায়নি।’

পড়াই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সুরাইয়ার

আখাউড়া এলাকায় ভাড়া থাকা দুলাল মিয়া পেশায় রিকশাচালক। তিন সন্তানসহ পাঁচজনের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাঁকে। বড় মেয়ে সুরাইয়া আক্তার আখাউড়া টেকনিক্যাল ইসলামিয়া আলিম মাদরাসায় পড়ত। অভাবের কারণে তার পড়াশোনা একসময় বন্ধ করে দেন বাবা দুলাল মিয়া। তবে শিক্ষক ও সহপাঠীদের তাগিদে আবার মেয়েকে পড়াতে পাঠান তিনি।

সংসারের অনটনের কারণে হাল ছাড়তে রাজি হয়নি সুরাইয়া। বাবার ওপর চাপ কমাতে ছোট শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জুগিয়ে আসছে সে। সুরাইয়া এবারের দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। তার এই অর্জনে পরিবারে বইছে আনন্দের বন্যা।

অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে দারিদ্র্যও যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না তা-ই যেন প্রমাণ করল সুরাইয়া।

নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার আদি বাসিন্দা সুমাইয়ার বাবা দুলাল মিয়া জানান, রুটিরুজির সমস্যায় তিনি এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন। সেখানেও কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় বাধ্য হয়ে নবম শ্রেণিতে থাকতে সুরাইয়ার পড়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।

দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমার মাইয়া প্রাইভেট পড়াইয়া হের লেহাপড়ার খরচ জোগাড় করছে। আমরা খুব খুশি।’

সুরাইয়া আক্তার জানায়, অভাবকে সে বাধা মনে করেনি। মনোবল ধরে রেখে নিয়মিত পড়াশোনা করেছে। শিক্ষক, সহপাঠীসহ সবাই সহযোগিতা করেছে। মা-বাবাও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তার ইচ্ছা চিকিৎসক হওয়ার।

মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক মো. রাকিবুল ইসলাম বলেন, ‘মেয়েটি খুব মেধাবী। তাকে মাদরাসার পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হয়েছে। আমিও তাকে প্রাইভেট পড়িয়েছি।’

ভাঙা ঘরের আলো কৌশিক

মাথা গোঁজার মতো এক টুকরা জমিও নেই কৌশিকের পরিবারের। সড়কের ধারে এক ঝুপড়িতে বাস করত তাদের পরিবার। উচ্ছেদ অভিযানে সেই ঘর হারিয়ে ঠাঁই মিলেছে অন্যের জমিতে। ঋণভারে জর্জরিত বাবার সংসারে অভাব নিত্যদিনের সঙ্গী। সংসারের অভাব কিছুটা মোচন আর নিজের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পড়াশোনার ফাঁকে দিনমজুরি আর হোটেল বয়ের কাজও করেছে কৌশিক। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও লক্ষ্য থেকে সরেনি সে। সব বাধা পেরিয়ে তাই সে পেয়েছে সাফল্য। মা-বাবার ভাঙা ঘরে ছড়িয়েছে আলোর দ্যুতি।

বিশাল সরকার কৌশিক কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সব বিষয়ে এ প্লাসসহ জিপিএ ৫ পেয়েছে। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হওয়া তার স্বপ্ন। তবে হতদরিদ্র বাবার সংসারে এই স্বপ্ন কিভাবে সফল হবে, তা জানে না সে। অভাবের কারণে এরই মধ্যে বাবা বলে দিয়েছেন, কলেজে তাকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াতে পারবেন না।

বিশাল সরকারের বাড়ি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী বাজারে। কাঁঠালবাড়ী বিদ্যাকানন থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাওয়ার পর সে ভর্তি হয় কুড়িগ্রাম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। বন্ধুর দেওয়া পুরনো প্যান্ট আর জুতা দিয়ে শুরু হয়েছিল তার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা। গতকাল সোমবার বিকেলে বিশালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ভাঙা চালাঘরে তাদের আবাস। পুরনো টিনের চালের ফুটো দিয়ে ঢোকা বৃষ্টির পানিতে ঘরের মেঝে কাদা হয়ে ছিল।

বিশাল জানাল, এসএসসি পরীক্ষা শুরুর দিনে ঘরে একটি টাকাও ছিল না। তাই তার মা প্রতিবেশীর কাছ থেকে টাকা ধার করে এনে অটোর ভাড়া দিয়েছিলেন। এমন দিনও গেছে সারা দিন খাওয়া জোটেনি তার। বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানো প্রাইভেট শিক্ষক, প্রতিবেশী, বন্ধু, দিশারী পাঠাগার এবং নিজের স্কুল পাশে না দাঁড়ালে এই সাফল্য পাওয়া কঠিন হতো তার জন্য। তাই সবার কাছে কৃতজ্ঞ সে।

ভালো ফল করে অনার্সে ভর্তি হলেও লেখাপড়া ছেড়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেও তেমন আয় না হওয়ায় কিস্তির দায় শোধ করতেই জেরবার। প্রতিবেশী ব্যবসায়ী শংকর দেবের সুপারিবাগানে ঘর তুলে আছেন।

পানের দোকানের আয়ে পড়া চালানোর লড়াই

নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চকময়রাম সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আরাফাত হোসেন এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেটি ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে আগামী দিনে আরো চমকপ্রদ ফল করতে চায়। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণের পথে বড় বাধা পরিবারের দারিদ্র্য। আরাফাতের বাবা হরীতকীডাঙ্গা বাজারের উত্তর পাশের বাসিন্দা মো. আব্দুল খালেক উজ্জ্বল। তিনি একটি পানের দোকানের সামান্য আয়ে সংসার চালান।

আরাফাত জানায়, পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি এবং সপ্তম শ্রেণিতে মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের ট্যালেন্টপুলে মেধা বৃত্তি পাওয়ার পর লেখাপড়ার প্রতি আরো বেশি মনোযোগী হয় সে। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির আর্থিকভাবে তাকে সাহায্য করেছেন। অভাবের কারণে তার সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়া সম্ভব না হলেও বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তপন কুমার মণ্ডল, সুব্রত মণ্ডল ও মো. আইয়ুব হোসেন সহযোগিতা করেছেন। আরাফাতের প্রত্যাশা এইচএসসি পাসের পর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করবে।

আরাফাতের প্রধান শিক্ষক এস এম খেলাল-ই রব্বানী বলেন, ‘বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সব সময় তার পড়াশোনার খোঁজ নিয়েছি। আরাফাত হোসেন নিয়মিত বিদ্যালয়ে ক্লাস করেছে। সে অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। আর্থিক নিরাপত্তা পেলে অনেক দূর এগিয়ে যাবে সে।’

আরাফাতের বাবা মো. আব্দুল খালেক উজ্জ্বল বলেন, ‘ছেলে এখন রাজশাহী কলেজ অথবা সৈয়দপুর বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু আমার আর্থিক সংকটের কারণে তার আশা হয়তো পূরণ না-ও হতে পারে।’

Author


Discover more from MIssion 90 News

Subscribe to get the latest posts to your email.

সম্পর্কিত সংবাদ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

Back to top button

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker