সরকার পরিবর্তনের পর মাদক পাচারের রুট পরিবর্তন করেছে পাচারকারীচক্র। সীমান্ত এলাকায় বিকল্প পথ বেছে নেওয়ার পাশাপাশি এখন ট্রেনেও তারা মাদক পাচার করছে, যা আগে সেভাবে ছিল না। মাদকদ্রব্যের মধ্যে ক্রিস্টাল মেথ ও আইসের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ হেরোইন ও কোকেন পাচার করছে তারা। মাদক কারবারিরা গত তিন মাসে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ বলেন, কোকেন-হেরোইনের চালান দেশে ঢুকছে। এর আগে দেশে কোকেনের যে চালানগুলো ধরা পড়েছিল, তার বেশির ভাগ এসেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। এসবের গন্তব্য ছিল ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা।
ডিএনসির পরিচালক তানভীর মমতাজ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের ভেতর কোকেনের এমন চাহিদা রয়েছে, সেটি আগে জানা ছিল না। কোকেনের এই নতুন ধরন এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে, আশা করিনি।’ এর সূত্র ধরে তারা জানতে পারেন, আন্তর্জাতিক মাদকচক্রের মাধ্যমে বর্তমানে হেরোইন-কোকেন আসা বাড়ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার অন্তত শতাধিক মাদক কারবারিকে ডিএনসিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক মাদক কারবারিচক্র এখন বাংলাদেশকে কোকেন ও হেরোইন পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ইয়াবার পর কোকেন ও হেরোইন এখন দেশের তরুণ ও যুবসমাজের জন্য বিরাট হুমকি বলে মনে করছেন তারা। মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স থাকলেও দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছে। এই জায়গায় সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা ও কিছু বেসরকারি সংস্থার আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
ডিএনসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীচক্র। তাদের সঙ্গে দেশের শীর্ষ মাদক কারবারিদের যোগসূত্র রয়েছে।
সর্বশেষ কোকেনের চালান উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, গোয়েন্দা তথ্যে বেনাপোল রেলস্টেশনে খুলনা-মোংলা-বেনাপোল রুটে চলাচলকারী ‘বেতনা এক্সপ্রেস’ ট্রেন থেকে এই মাদকের চালান জব্দ করা হয়। বিজিবির উপস্থিতি টের পেয়ে ব্যাগটি ফেলে মাদক পাচারকারীরা পালিয়ে যায়।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ বলেন, শুধু কোকেন নয়, হেরোইনও জব্দ করা হয়েছে। জব্দ করা কোকেন ও হেরোইনের বাজারমূল্য এক কোটি ৭১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোকেনের মূল্য এক কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও হেরোইনের মূল্য ৩৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।
বিজিবি সূত্র জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এই কোকেন জব্দ করা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। তবে এই কোকেন দেশের ভেতরেই বেচাকেনার জন্য সরবরাহ করা হচ্ছিল বলে ধারণা বিজিবির।
পুলিশ ও র্যাবের কাছে তথ্য রয়েছে, বেনাপোলের পুটখালী, শিকারপুর, রঘুনাথপুর, অভ্রভুলাট ও দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত মাদক ঢুকছে দেশে। আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসায়ীচক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য এতে জড়িত।
মাদকসেবীরা যা বলছে
রাজধানীতে একাধিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন হেরোইন ও কোকেনে আসক্ত অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা পারিবারিক নানা অশান্তির পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে, মাদক ব্যবসায়ীদের দ্বারা আসক্ত হয়ে পড়েন। এর মধ্যে অনেক তরুণীও রয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক তরুণী বলেন, ‘আমি মাদক কারবারিদের টার্গেটের শিকার। মাদকের টাকা জোগাড় করতে বাবার পকেট, মায়ের জমানো টাকা চুরি করে মাদক সেবন করতাম। একসময় পরিবার সব জেনে আমাকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে। সেখান থেকে কিছুদিন পর পালাই। এরপর ফের মাদক সেবন শুরু করি। পরিবার শেষমেশ আমাকে আহছানিয়া মিশন মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করে।’
চিকিৎসকদের ভাষ্য
চিকিৎসকরা বলছেন, কোকেন মূলত এক ধরনের উদ্দীপক মাদক। জানতে চাইলে ‘মানস’-এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. অরূপ রতন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, কোকেন সেবনকারী ব্যক্তি স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক স্বাস্থ্যগত ও মানসিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। কোকেন ব্যবহারের ৪৮ ঘণ্টা পরও প্রস্রাবে এর উপস্থিতি থাকে, যা অন্য মাদকে থাকে না। এ ছাড়া অন্য মাদকসেবীর চেয়ে কোকেনসেবীদের ২৪ গুণ বেশি হার্ট অ্যাটাকের শঙ্কা থাকে।
৭০০ কোটি টাকার হেরোইন জব্দ
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সূত্র বলছে, দেশে গত এক বছরে চোরাপথে আসা ৭০০ কেজি ৯২৮ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়েছে। একই সময় কোকেন জব্দ করা হয়েছে ১৩ কেজির বেশি। আবার গত ১৫ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি হেরোইন জব্দ করা হয়েছে।
ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলেন, জব্দ হওয়া প্রতি কেজি হেরোইনের মূল্য কমবেশি এক কোটি টাকা। সে হিসাবে গত বছর জব্দ হওয়া ৭০০ কেজি হেরোইনের দাম ৭০০ কোটি টাকা।
প্রায় এক লাখ মামলা
ডিএনসির সমন্বিত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৯৭ হাজার ২৪১টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামি ১২ লাখ ২৮৭ জন। সেই তুলনায় গত তিন মাসে মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছে কম। মাদক উদ্ধারও কম হয়েছে।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘৫ আগস্ট-পরবর্তী দেশে মাদকের কারবার কিছুটা বেড়েছে। তবে আমরা মাদক কারবারিদের তালিকা করে অভিযান অব্যাহত রেখেছি। দেশের যেসব সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক বেশি ঢুকছে, সেসব এলাকায় আগের চেয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’
আরো কোকেনের চালান জব্দ
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোকেনের ১০টি চালান ধরা পড়েছে। প্রতিটিতেই বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২০ জনকে এসব মামলায় আসামি করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এর আগে ২০১৩ সালে তিন কেজি কঠিন কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
গত ২৫ জানুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আফ্রিকার দেশ মালাউয়ির এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করে আট কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেন উদ্ধার করা হয়। পরে ওই বিদেশি নাগরিকের তথ্যের ভিত্তিতে আরো তিনজন বিদেশি নাগরিকসহ চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সে সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, বাংলাদেশে এটাই এখন পর্যন্ত কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান, যা মালাউয়ি থেকে ইথিওপিয়া ও দোহা হয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসে।
২০২৩ সালের জুনেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক নারীকে পৌনে দুই কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া গত বছরের ১৭ জুলাই শ্যামলী এলাকার একটি বাসা থেকে ১০ গ্রাম কোকেন জব্দ করে ডিএনসি। এ ঘটনায় সোবহানা রহমান নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করে জানা যায়, তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে কোকেন নিয়ে আসতেন তিনি। এরপর রাজধানীর অভিজাত এলাকায় এসব কোকেন বিক্রি করতেন।