বিবিধ

ছেলের কাছে মা এর লেখা চিঠি

বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল মানে বৃদ্ধাশ্রম । অন্য অর্থে জীবনের শেষ সময়ের আবাস স্থল, বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় নিজেরাই হয়ে যান অচল, জরাজীর্ণ বার্ধক্য আক্রান্ত হয়ে চরম অসহায়ত্ব বরণ করে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বৃদ্ধাশ্রম নামীয় কারাগারে স্থান পেতে হয়।

এক সময় যারা নামী দামী বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও চাকরিজীবী ছিলেন, বর্ণাঢ্য ছিল যাদের জীবন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারাই।

সন্তান না খেলে যারা খেতেন না, সন্তান না ঘুমালে যারা ঘুমাতেন না, সন্তান অসুস্থ হলে যারা ঠায় বসে থাকতেন শিয়রে, যে বাবা-মা তিলে তিলে নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানদের মানুষ করার জন্য। সেই বাবা-মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা এখনকার বৃদ্ধাশ্রম গুলোতে। মানবতার প্রতি এ এক চরম উপহাস।

দেখা গেছে এক সময়ে প্রতিষ্ঠিত মা-বাবা বৃদ্ধা শ্রমে। সন্তানরা যে যার মত অন্য দেশে অবস্থান করছে কোন খোঁজ খবর নিচ্ছে না। মা এর সাথে কন্যার সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া।

বাবা তার ছেলেকে হাত খরচের জন্য ১০ হাজার টাকার জন্য ১২ হাজার টাকা দেয়ার অনুরোধ করে কেননা তার বাবা এখন কাজ করে খেতে পারেন না এবং বিভিন্ন রোগ শোকে জর্জরিত। ছেলে সেটা সরাসরি না করে দেয়। অথচ এই ছেলের জন্যই যখন বেকার ছিল তাকে মোটরসাইকেল কিনে দেয়।

ওই মোটরসাইকেল চুরি হয়ে যাওয়ার পর আবার ১৫ দিন পরে আরেকটি মোটর সাইকেল বাবা তাকে কিনে দেন। অন্য পরিবারের আর এক ছেলে, বাবার সাথে তর্ক বিতর্ক চলতে থাকে, ছেলে এক পর্যায়ে উদ্ধত হয় হাতে বঁটি নিয়ে বাবাকে কোপানোর জন্য। অথচ এই ছেলেকেই সে কোলে পিঠে মানুষ করেছন এবং অভাব কোন সময় বুঝতে দেয় নি, কিনে দিয়েছেন মোটরবাইক।

বিয়ের সমস্ত খরচ মা-বাবা বহন করেন, কিনে দেন গাড়িও। বৃদ্ধাশ্রম থেকে মা তার ছেলে খোকা কে চিঠি লিখে স্মরণ করিয়ে দেয় আমার চশমা টা ভেঙে গেছে তাই অন্য একজন কে দিয়ে চিঠি টি লিখিয়েছেন, মা ছেলে কে বলেছিলেন ছয় মাস আগে একটি চশমা কিনে দিতে কিন্তু এখনো তা পায় নি।

নিশ্চয়ই ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যা সাগরের মায়ের ডাক লেখার কথা মনে আছে, তিনি লিখেন, মা অসুস্থ, সন্তানকে বাড়ি যেতে পত্র লিখেছেন। এখন মায়ের ডাকে সাড়া দিতেই হবে। অফিসের বড় কর্তার কাছে ছুটি চেয়ে বিফল হলেন। ছুটি মঞ্জরী হলো না। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে হলো ঈশ্বরচন্দ্রকে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে।

শুরু হয়েছে ভীষণ ঝড়-বাদল। দামোদরের তীরে পৌঁছে দেখলেন নদী পার হওয়ার মতো একটি খেয়া নৌকাও ঘাটে নেই। কিন্তু তাকে যে মায়ের কাছে যেতেই হবে! ঝড়ের রাতে খরস্রোতা দামোদর নদী সাঁতরে পাড়ি দিলেন ঈশ্বরচন্দ্র।

শরীর খুব ক্লান্ত। হাঁটতে হাঁটতে পোঁছালেন মেদিনীপুরের বীর সিংহ গ্রামে মা ভগবতী দেবীর কাছে। মা ছেলেকে দেখে খুব খুশি। বললেন, আমি জানতাম, তুই আসবি।

আর বর্তমানে অসুস্থ বা অসহায়ত্বের কথা শুনলে সন্তানের ইউটার্ন মেরে নদী তো ভাল কথা আটলান্টিক মহাসাগর সামনে পড়লে তা সাতরিয়ে অন্য দেশের চলে যাবে। আমেরিকা বা ইউরোপের দেশ গুলিতে বৃদ্ধাশ্রম আর আমাদের দেশের শ্রম পরিস্থিতি আলাদা। ঐ সব দেশে মা-বাবাকে বৃদ্ধা শ্রমে পাঠিয়ে বছরে একবার তাদের সাথে দেখাশোনা বা কুশল বিনিময় করে।

কিন্তু আমাদের দেশে অধিকাংশ সন্তান মা-বাবা কে বৃদ্ধা শ্রমে পাঠিয়ে এক বছরে নির্ধারিত দিনে ও দেখা করার সময় হয় না। কিন্তু সরব থাকে ফেসবুকে। মা-বাবার প্রতি সন্তানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের প্রমাণ পাওয়া গেছে কোভিড-১৯ এর সময় কালে।

অথচ আল্লাহ তা আলা মায়ের কষ্ট ও তাদের প্রতি সন্তানদের বরণীয় বর্ণনা করে কুর আনে ইরশাদ করেন-‘আমি ‘মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি (কারণ) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’ বছরে- তুমি শোকর কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে তোমাদের ফিরে আসতে হবে।‘ -সুরা লোকমান (৩১) : ১৪।

আরেক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া আর কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্য উপনীত হয় তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, বরং তাদের সাথে সম্মান জনক কথা বল এবং তাদের প্রতি মমতা পূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনতা কর ও দু আ কর, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।”-সুরা বনী ইসরাঈল, (১৭):২৩-২৪।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চিনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজ বংশের। খৃস্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ।

পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধা শ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা। কিন্তু এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার বাবা-মাকে বৃদ্ধ নিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সবকিছু থেকে দায়মুক্তি ঘটে। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণা বোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধা শ্রমের সৃষ্টি।

যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধা শ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। বর্তমান সমাজে এমন কিছু অভাগা মা-বাবা আছেন, যাদের দিনাতিপাত হয় চোখের পানিতে ও প্রতীক্ষায়। তাদের ডাক পৌঁছায় না সন্তান ও স্বজনের কাছে।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

এছাড়াও পরীক্ষা করুন
Close
Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker