জাতীয়

“স্বাধীনতার রক্তাক্ত সূর্য: গৌরব, ত্যাগ আর দায়িত্বের প্রতিশ্রুতি”

আজ ১৬ ডিসেম্বর। এই দিনটি শুধু তারিখ নয়, একটি জাতির আত্মগৌরবের, ত্যাগের এবং বিজয়ের চির অম্লান স্মৃতি। ১৯৭১ সালের এই দিনটি আমাদের ইতিহাসের সেই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, যখন স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য সকল কালো আঁধার ভেদ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই দিনেই জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের, যার প্রতিটি ধূলিকণা ভেজা রক্তের গৌরবে।

আমরা আজ স্বাধীনতার ৫৩ তম বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করছি। তবুও মনে হয়, স্বাধীনতার সেই যুদ্ধ যেন আজও শেষ হয়নি। অত্যাচারী শাসকের শৃঙ্খল ভাঙতে, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আমাদের ছাত্র জনতার অব্যাহত সংগ্রাম আজ আবার নতুন এক বিজয়ের বার্তা দিয়েছে। আমরা প্রমাণ করেছি, এই দেশের মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনো মাথা নত করেনি, করবেও না।

আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, এবং অগণিত শহীদ যারা নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন—তাঁরা আমাদের আত্মার শক্তি। সেই মায়েরা, যারা সন্তান হারিয়েছেন, সেই নারীরা, যারা সম্ভ্রম হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। অনেক ত্যাগেই আমরা পেয়েছি আমাদের বাংলাদেশ।

আজকের দিনে এই বিজয়ের প্রার্থনা করি, এই দেশ যেন সত্যিকার স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। যে বাংলাদেশ আমরা ভালোবাসি, যে বাংলাদেশ আমাদের রক্তে, আমাদের হৃদয়ে—সেই বাংলাদেশ হোক শান্তি, সমৃদ্ধি, আর ন্যায়ের প্রতীক। জয় হোক স্বাধীনতার, জয় হোক বাংলাদেশের!

আমাদের ইতিহাস রক্তে লেখা, এক ইতিহাস যেখানে বন্দুকের শব্দ, আগুনের স্ফুলিঙ্গ আর শহীদের রক্ত মিশে রয়েছে জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে। একদিন আমাদের ছিল কেবল একটি স্বপ্নের পতাকা, তারপর এলো স্বাধীন দেশ, আর আজ সেই দেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই গৌরবময় স্বাধীনতার পিছনে আছে লাখো শহীদের আত্মত্যাগ, আছে অসীম সাহস আর অগাধ ভালোবাসার প্রমাণ। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বপ্নের বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ আমাদের হৃদয়ের আবেগ, গর্ব আর ভালোবাসার প্রতীক। আমরা গর্বিত, আমরা স্বাধীন, আমরা বাংলাদেশ!

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের শাসনের অন্ধকার অধ্যায় শুরু হয়, আর সেই অন্ধকার ভাঙতে আমাদের বিপ্লবের শুরু ১৯৫২ থেকে, যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭১ সালে। ত্রিশ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই বাংলাদেশ—আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। কিন্তু আজ, এত রক্ত, এত ত্যাগ, এত সংগ্রামের পর আমরা কী করছি দেশের জন্য? স্বাধীনতা উদ্‌যাপন শুধু দিবসের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ, দেশপ্রেম যেন শুধুই আনুষ্ঠানিকতার প্রদর্শনী। দেশের জন্য ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ আর আনুগত্য থাকার কথা, যা আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি আর মানবিকতারই শিক্ষা—তাই কি আমরা ভুলে গেছি? 

বিজয় বা স্বাধীনতা—এই দুটি শব্দ আমাদের হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব গৌরব, ত্যাগ আর চেতনার স্পর্শ এনে দেয়। ১৯৭১ সালের সেই রক্তক্ষয়ী অধ্যায় কেবল ইতিহাস নয়, তা আমাদের অস্তিত্বের শেকড়। লক্ষ প্রাণের ত্যাগ, ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতা, যা আমাদের একটি দেশ দিয়েছে, একটি পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু আমরা কি এই অর্জনের মর্যাদা দিতে পেরেছি? আমরা কি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? আমাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডেই প্রমাণ হয় যে আমরা কতটা উদাসীন। আমরা দেশের সম্পদ নষ্ট করি, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই, নিজেদের স্বার্থে দেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করি। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ যদি বুঝতাম, তাহলে এভাবে দেশের ক্ষতি করতে পারতাম না।

স্বাধীনতার অনুভূতি এক অসীম আবেগের নাম। বিজয়ের প্রথম সূর্য দেখার সময় সবাই কল্পনা করেছিল একটি মুক্ত বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না কোনো অত্যাচার, শোষণ বা ভয়। একটি পতাকা, একটি জাতি, একটি দেশ—এই স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন বাংলার মানুষ। কিন্তু সেই স্বাধীনতার মূল্য যে কত বিশাল, তা হয়ত কেউ বুঝতে পারেনি। রক্তের মিছিল, শহীদের আত্মদান, বুক চিরে স্লোগান দেওয়া সাহসী জনতা—সবাই মিলে রচনা করেছে স্বাধীনতার ইতিহাস। তাদের সেই ত্যাগের পরও আজ আমরা কি নিজেদের স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক হতে পেরেছি?

স্বাধীনতা অর্জন সহজ ছিল না, আর তা রক্ষা করা আরও কঠিন। আমরা প্রতিনিয়ত দেশের সম্পদ নষ্ট করি, দেশের আইন মানতে অবহেলা করি। রাস্তায়, বাসে, ট্রেনে আমরা নিজেরা দেশের সম্পদের ক্ষতি করি। দায়িত্বে অবহেলা আর দুর্নীতির চর্চা যেন আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। অথচ এই দেশ, এই সম্পদ আমাদের সবার। আমাদের দায়িত্ব দেশের উন্নয়নে অবদান রাখা, ত্যাগের মহিমাকে ধরে রাখা। কিন্তু আমরা তা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। স্বাধীনতার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদের আগে নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে।

বিজয়ের এই দিনে আমাদের উচিত একটি অঙ্গীকার করা—আমাদের দ্বারা আর কখনো দেশের ক্ষতি হবে না। প্রতিটি কাজ সৎভাবে করব, দেশের প্রতি দায়িত্বশীল থাকব। যদি প্রয়োজন হয়, দেশ রক্ষার জন্য জীবনও দিতে প্রস্তুত থাকব। স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন, আর তা রক্ষা করা আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। একটি দেশ শুধু ভূখণ্ড নয়, এটি আমাদের ভালোবাসার, আত্মত্যাগের, সম্মানের জায়গা। আমরা যেন আমাদের কর্মকাণ্ডে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে পারি, আমরা সত্যিকারের বিজয়ী।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker