দেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুহার কমানোর উদ্দেশে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেওয়া ২৭১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় সাঁতার শিখতে ১৬ জন কর্মকর্তা দুটি দলে ভাগ হয়ে বিদেশে যাবেন। এর পেছনে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।এক প্রতিবেদনে অনলাইন সংবাদমাধ্যম সময়ের আলো জানায়, মঙ্গলবার (২২ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) নাসিমা বেগম জানান, দুটি দলে ৮ জন করে ১৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে যাবেন। এর জন্য ৩০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। আর বাকি টাকা পরবর্তী সময়ে বিদেশে কোনো সেমিনার হলে সেখানে পাঠানোর জন্য রাখা হয়েছে।প্রকল্পের বিষয়ে তিনি জানান, শুধু সাঁতার শিখতে নয়, বাচ্চাদের সুরক্ষা, বিকাশ এবং বাচ্চাদের ছোটবেলাটা কীভাবে সুন্দর করে কাটানো যায়, এজন্য প্রশিক্ষণের দরকার আছে। চাইল্ড কেয়ারের বিষয়টি কর্মকর্তাদের শেখাতে এ বিদেশ সফরের অপশন রাখা হয়েছে। মূলত শিশুদের বাবা-মা যখন ঘরের বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকেন সে সময়টা সন্তানদের কীভাবে ডে-কেয়ারে রেখে সুন্দর লাইফ দেওয়া যায় সেটাই তারা দেখতে যাবেন।
প্রকল্পটির আওতায় ৯৮০ কর্মকর্তা দেশেই সাঁতার শেখার প্রশিক্ষণ নেবেন, যেখানে ব্যয় হবে ১১ কোটি ৪ লাখ টাকা। একেকজনের বিদেশ ভ্রমণে খরচ পড়বে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা।এ প্রসঙ্গে নাসিমা বেগম জানান, এখানে শুধু ৯৮০ জন কর্মকর্তাই নন, আরও অনেককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এখানে বেশি ব্যয় রাখা হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, দিনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ৫ বছরের নিচের বয়সি শিশুদের বিকাশ উপযোগী সেবা প্রদান, ১-৫ বছর বয়সী শিশুর জন্য কেন্দ্রভিত্তিক সমন্বিত ইসিসিডি সেবা প্রদান যাতে শিশুর শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক, ভাষাগত এবং জ্ঞানবুদ্ধির বিকাশ নিশ্চিত হয়, ৬-১০ বছর বয়সী শিশুদের নিরাপদ সাঁতার শেখানোর মাধ্যমে তাদের পানিতে ডুবে যাওয়া থেকে সুরক্ষা প্রদান, জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে ইসিসিডি বিষয়ে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার সামর্থ বৃদ্ধি যাতে সংস্থাগুলো শিশুদের নিরাপত্তা এবং বিকাশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুর বিকাশ ও সুরক্ষার সর্বোত্তম পরিকল্পনা এবং সমন্বিত কার্যক্রমে পরিবার এবং এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততার কার্যক্রম গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অভিভাবকদের শিশু লালন-পালন বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
এদিকে, সাঁতার শিখতে বিদেশ যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণে প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে, শিশুর সুষ্ঠু শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, সামাজিক ও আবেগীয় বিকাশে জীবনের প্রথম আট বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছু মৌলিক চাহিদা, বিশেষ করে খাদ্য, পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং শিক্ষার চাহিদা পূরণ করা শিশুদের বেঁচে থাকা ও জীবনকে পরিপূর্ণ সম্ভাবনাময় করার জন্য অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, প্রসবকালীন মৃত্যুহার হ্রাস এবং প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিশুদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু অপর্যাপ্ত সমন্বিত প্রারম্ভিক শিশুযত্নের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুরক্ষা ও নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের অনেক শিশুই গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। এই বয়সী শিশুমৃত্যুর বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, পানিতে ডুবে মৃত্যু ৮৮% পর্যন্ত প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পানিতে ডুবে মৃত্যু রোধে ৩টি কৌশল সবচেয়ে কার্যকর। এগুলো হলো- ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য নিরাপদ ও সাশ্রয়ী শিশু-যত্নের সুযোগ সৃষ্টি করা, পানিতে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো এবং শিশুদের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং তা হ্রাসের পদ্ধতি সম্পর্কে জনসাধারণ, মা-বাবা ও অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানো। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৩টি প্রতিরোধ কৌশলই অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প মেয়াদে ১৬টি জেলায় ৪৫টি উপজেলার নিম্নোক্ত ৩টি লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেগুলো হলো- ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য আট হাজার কমিউনিটিভিত্তিক সমন্বিত শিশু-যত্ন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা। এছাড়া, ৬-১০ বছরের শিশুদের সাঁতার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ১৬০০ জন প্রশিক্ষককে সাঁতার প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া এবং অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে শিশুর যত্ন, বিকাশ ও শিশু সুরক্ষার সর্বোত্তম চর্চার বিষয়ে তথ্য প্রদান এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে প্যারেন্টিং সেশন পরিচালনা।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে তিনটি লক্ষ্য নিয়ে ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা সমীক্ষায় বিশেষ বিষয় হিসেবে দেখানো হয়, প্রতি বছর পানিতে ডুবে প্রায় ১৯,৪৭ জন মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। সমীক্ষায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। এ মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটে সাধারণত বাড়ির ২০ মিটারের মধ্যে অবাঞ্ছিত জলাধারে এবং দিনের প্রথমভাগে। গ্রামাঞ্চলে পুকুর আর
ডোবার মতো ছোট ছোট জলাধারের সংখ্যা শহরাঞ্চলের চেয়ে তুলনামূলক বেশি থাকায় পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি দেখা যায়।পরিকল্পনা কমিশনের ভাষ্যমতে, শিশুদের সাঁতার শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের যদি এ বিষয়ে সচেতন করা যায় তাহলে মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব। এ প্রকল্পের প্রস্তাবিত কার্যক্রম শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আবেগিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সার্বিক বিবেচনায় প্রকল্পটি অনুমোদন করা যেতে পারে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রকল্পটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুনের মাঝে বাস্তবায়ন করবে।
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.