বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলা। এর বাইরে উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি অপরিহার্য ভাষা হিসেবে রয়েছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় বাংলা মাধ্যমে। ইংরেজি মাধ্যমের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য ভাষাভাষি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ থেকে যাচ্ছে অধরা।
বাংলাদেশ সরকার সকল শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ নিশ্চিত করতে প্রথম দফায় পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন এবং অনুযায়ী শিশুদের পড়াশোনা শুরুর উদ্যোগ গ্রহণ করে ২০১২ সালে। প্রথমে পার্বত্য অঞ্চলের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের সাদরি ও গারো এই পাঁচটি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগে ম্রো, মণিপুরি, তঞ্চঙ্গ্যা, খাসি, বমসহ ছয়টি ভাষায় এবং তৃতীয় ভাগে কোচ, ওঁরাও (কুড়–ক), হাজং, রাখাইন, খুমি ও খ্যাং ভাষার পর অন্য ভাষাতেও প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হবে বলে জানানো হয়।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৫টি ভাষায় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে প্রাক-প্রাথমিকের আদিবাসী শিশুদের হাতে নিজ নিজ ভাষার বই তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু সেটি সম্ভব হয় ২০১৭ সালে। কিন্তু ওই ভাষার শিক্ষক বা প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
বর্তমানে করোনা মহামারীর প্রভাবে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই সময়ে শহরকেন্দ্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইনে হাজিরা নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম প্রচেষ্টা চললেও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে নতুন কোনো কার্যক্রম নেওয়া হয়নি।
“এখানে বই ছাপানো, কিছুকিছু জায়গায় বিতরণ করা ছাড়া আর কিছু হয়নি সরকারিভাবে।”- দেবাশীষ রায়
বাংলাদেশের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে চাকমারা জনসংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। মাতৃভাষায় শিক্ষার বাস্তব অবস্থা বিষয়ে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায় বলেন, “মাতৃভাষায় শিক্ষার কথা যদি মৌলিকভাবে বলতে হয়, তবে সেটি হচ্ছে না। এখানে বই ছাপানো, কিছুকিছু জায়গায় বিতরণ করা ছাড়া আর কিছু হয়নি সরকারিভাবে। অর্থাৎ, শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এসব হয়নি। শিক্ষার্থীদের মৌলিকভাবে নিজের ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার আর কোনো উদ্যোগ নাই। তবে বিভিন্ন এনজিও এবং জেলাপরিষদের মাধ্যমে কিছু কর্মসূচী হয়েছে।”
“আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা করাই হয়েছে এই ভাষাগুলোকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে।”- মহিবুল হাসান চৌধুরী
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষাদানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ে বলেন, “আমাদের দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটা করাই হয়েছে এই ভাষাগুলোকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে। আমাদের দেশে যারা বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছেন তারাও ইংরেজি শিখছেন। এটা ইংরেজির বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসারের কারণেই করতে হচ্ছে। ইংরেজি যেভাবে উচ্চশিক্ষার ভাষা হয়েছে সেভাবে বাংলা হতে পারছে না। প্রয়োজনীয় বই, গবেষণা স্বল্পতা এর কারণ। আবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষায়ও তাই উচ্চশিক্ষা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ভষাগুলো যাতে হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যেই তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার বিষয়টি আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। ভাষার ব্যবহার কমে যাওয়া ভাষার জন্য একটি হুমকি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা যাতে স্কুলে নিজেদের মাতৃভাষার একটা চর্চা করতে পারে তাই এটি রাখা হয়েছে। উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে, পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে একসময় এর সুফল পাওয়া যাবে।”
“দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ইনস্টিটিউট থাকলেও সেখানে আমাদের দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কোনো বিভাগ নেই।”- জোবাইদা নাসরীন
বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন-২০১০’ প্রণীত করেছিল সরকার। কিন্তু ঢাকায় অবস্থিত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট যে সমীক্ষা শুরু করেছিল তা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা হয়নি। ফলে দেশে কয়টি আদিবাসী জাতি আছে, তাদের ভাষার সংখ্যা কত, এসব ভাষার অবস্থাই-বা কেমন তা নিয়ে সরকারিভাবে পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্যও নাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, “আমাদের দেশে প্রায় ৭০টির মতো আদিবাসী গোষ্ঠি রয়েছে। আমাদের স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে যদি তাকাই, দেখবো এখানে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে দেখা হয়। তাদের ভাষা নিয়ে হাসাহাসি করা হয়। এতে করে তারা তাদের নিজের ভাষায় কথা বলতে সংকোচ বোধ করে। বিড়ম্বনা এড়াতে তারাও বাংলা ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। আবার দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ইনস্টিটিউট থাকলেও সেখানে আমাদের দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে কোনো বিভাগ নেই। অথচ, সেখানে ভিনদেশী নানা ভাষা শিক্ষার কোর্স রাখা হয়েছে। ইউনেস্কো বলছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্তত ২ হাজার ভাষা হারিয়ে যাবে। এর মধ্যে আমাদের বাংলাদেশের আদিবাসীদের ভাষাও রয়েছে। ভাষা রক্ষায় আদিবাসী ভাষার সাহিত্য প্রকাশের দিকে জোর দেওয়া যেতে পারে। আমরা জানি যে, মানুষ বাঁচে ভাষায়। আর ভাষা টিকে থাকে লেখায় বা সাহিত্যে।”
“বায়ান্নতে মাতৃভাষার দাবিতে যে দেশে শহীদ হয়েছে, সেই দেশে ভাষা হারিয়ে যাবে, ভাষা রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে না, এটা দুঃখজনক।”- সঞ্জীব দ্রং
“আমার দিকে লোকজন আলাদাভাবে তাকায়।”- তুরিং দেওয়ান
তুরিং দেওয়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ২০১৯-২০ সেশনে ভর্তি হয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির চাকমা পরিবারের মেয়ে তুরিং এর আগে পড়াশোনা করেছেন রাঙামাটির লেকার্স পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে। ২০১৩ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখান থেকেই এইচএসসি শেষ করে ভর্তি হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুরিং-এর সঙ্গে কথা হচ্ছিল শিক্ষার্থী হিসেবে তার অভিজ্ঞতা নিয়ে।
তুরিং বললেন, “সব জায়গাতেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির একজন হিসেবে বিবেচিত হয়েছি। ঢাকার লোকাল বাস থেকে শুরু করে, ক্যাম্পাসে, খাবার দোকানে, শপিং মলে, প্রতিটি সময়েই মনে হয় আমি আলাদা। আমার দিকে লোকজন আলাদাভাবে তাকায়। একজন বাংলাদেশি হিসেবে নয়, একজন চাকমা হিসেবে সবাই আমাকে তাকিয়ে দেখে। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি অস্বস্তি নিয়ে চলতে হয়।”
দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি হওয়ার আগে শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আমি বাংলা মাধ্যমেই পড়াশোনা করেছি। পরিবারের বাইরে আসলে চাকমা ভাষায় যোগাযোগের খুব একটা সুযোগ নাই। নিজেদের ভাষায় তাই আমরা প্রাথমিক শিক্ষাও তেমন পাইনি।”
তুরিং-এর বাবা পুষ্পল দেওয়ান জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা ইউএনডিপিতে কর্মরত। মা পুতুলী চাকমা গৃহিণী। তুরিং বর্তমানে অবস্থান করছেন ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায়। সেখানে আইএসএসএফ গ্র্যান্ড প্রিক্স রাইফেল ও শুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বাংলাদেশ দলের হয়ে অংশ নিয়েছেন। তুরিং বলেন, “আমাদের মধ্যে কিছুটা অগ্রসর কিংবা পিছিয়ে পড়া যে পরিবারেরই হোক না কেন, পরিবার থেকে দূরে গিয়ে প্রথমে মিশতে পারি না, কেউ আমাদের সহজভাবে গ্রহণ করে না। অনেকেই আছেন যারা ঢাকায় এসে প্রথমে বেশ সমস্যায় পড়েন, নিজেদের ভাষার বাইরে অনেকে তেমন যোগাযোগে দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। আমরা ছোটবেলায় যে সকল বন্ধুদের সাথে পড়াশোনা করেছি তাদের অনেকে নিজেদের চেনাজানা জায়গাতেই থাকতে চেয়েছেন, পরিবারও তাদের দূরে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী হয় না।”
Discover more from MIssion 90 News
Subscribe to get the latest posts sent to your email.