জাতীয়

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল: জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘নির্দেশদাতা’ ছিলেন শেখ হাসিনা

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা জুলাই-আগস্টের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে; রিপোর্টে হাসিনাকে ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে দাবি করা হয়েছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি বা ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়সহ মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।

গতকাল সোমবার (১২ মে) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামের কাছে এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এই প্রতিবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে জেনোসাইড বা গণহত্যার কোনো অভিযোগ আনা হয়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর।

উল্লেখ্য, এত দিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনা ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে গণহত্যার অভিযোগও উচ্চারণ করে আসছিলেন। এমনকি এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে গত ৯ মে নিজের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করে লিখেছিলেন:

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই ‘গণহত্যার’ তদন্ত রিপোর্ট আগামী সোমবার (গতকাল) চিফ প্রসিকিউটর বরাবর দাখিল করবে বলে আশা করছি। তদন্ত রিপোর্ট দাখিল হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ অর্থাৎ ‘ফরমাল চার্জ’ দাখিলের মাধ্যমে হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপ ও আন্দোলনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে সংবাদে বলা হয়, আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে গত ৮ মে রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাকর্মীরা। পরদিন তাঁদের এই অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানায় জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এদিন তাঁরা মিন্টো রোডের প্রবেশ মুখে মঞ্চ বানিয়ে সেখানে সমাবেশও করেন। সমাবেশ থেকে হাসনাত আবদুল্লাহ শাহবাগ অবরোধের ঘোষণা দেন। পরে তাঁরা মিন্টো রোড থেকে সরে এসে শাহবাগে অবস্থান নেন। এই আন্দোলন চলার মধ্যে ৯ মে দুপুরে চিফ প্রসিকিউটর তাঁর ফেসবুক আইডিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে ওই পোস্টটি দেন।

সেই ধারাবাহিকতায় সোমবার (গতকাল) এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর দুপুরে প্রসিকিউশন টিম নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। আগামী ২৪ জুন ট্রাইব্যুনালে এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের আনুষ্ঠানিক তারিখ নির্ধারিত রয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের মূল অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ:

সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর জানান, তদন্ত সম্পন্ন করতে ছয় মাস ২৮ দিন লেগেছে। শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ‘মাস্টারমাইন্ড’ উল্লেখ করে তিনি বলেন:

জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে দেশব্যাপী সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যাকাণ্ড, গুলি করে আহত করা, লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার মতো যে অমানবিক কর্মকাণ্ড হয়েছে, এসবের প্রধান মাস্টারমাইন্ড, সর্বোচ্চ হুকুমদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, এই অভিযোগগুলোর মধ্যে দুটি তিনি জানাতে পারবেন:

  • প্রথম অভিযোগ: উসকানি ও প্ররোচনা: (গত বছর) ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুত’—এসব বলার মধ্য দিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বিভিন্ন বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি সহযোগী বাহিনী হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। কৃত এসব অপরাধ প্রতিহত না করে তিনি উসকানি দিয়েছেন, প্ররোচনা দিয়েছেন, সম্পৃক্ত থেকেছেন এবং ষড়যন্ত্র করেছেন।
  • দ্বিতীয় অভিযোগ: সরাসরি নির্দেশনা: তদন্তে শেখ হাসিনার কিছু টেলিফোন কনভারসেশন (কথোপকথন) জব্দ করেছে তদন্ত সংস্থা। একাধিক কনভারসেশন রয়েছে। সেসব কনভারসেশনে সুস্পষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয় নিরস্ত্র, নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর। তাঁদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল করার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশের প্রমাণ তদন্ত সংস্থা হাতে পাওয়ায় দ্বিতীয় অভিযোগটি আনা হয়েছে।

বাকি তিনটি অভিযোগ সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, কীভাবে মানুষকে মারা হয়েছে বা নৃশংসতা চালানো হয়েছে সে ব্যাপারে।

সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর আরও উল্লেখ করেন, জুলাই-আগস্টে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় দেড় হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে, ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়েছে, নারীদের ওপর গোপনে বিশেষভাবে সহিংসতা চালানো হয়েছে, টার্গেট করে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর লাশ এবং জীবিত মানুষকে একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আহতদের হাসপাতালে নিতে বাধা এবং শহীদদের পোস্টমর্টেম বা চিকিৎসায় বাধা দেওয়ার মতো তথ্যপ্রমাণও তদন্তে উঠে এসেছে। শেখ হাসিনা নাকি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকদের আহত রোগীদের চিকিৎসা না দেওয়ার নির্দেশও দিয়েছিলেন। সরকারি স্থাপনায় নিজেদের লোক দিয়ে আগুন ধরিয়ে তার দায় আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানোর নির্দেশনাও তিনি দিয়েছিলেন বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর, যার কথোপকথনের প্রমাণ তদন্ত সংস্থা পেয়েছে।

প্রমাণের জন্য ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স:

মামলা প্রমাণে বহুমাত্রিক ডিজিটাল অ্যাভিডেন্স ব্যবহার করা হবে জানিয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক, আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা এবং শহীদ পরিবারগুলোর সদস্যরা সরাসরি সাক্ষী হিসেবে আসবেন। প্রমাণ হিসেবে কল রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ, আহত-নিহতদের শরীর থেকে সংগ্রহ করা গুলি, আন্দোলন দমনে ব্যবহৃত হেলিকপ্টার, ফ্লাইট শিডিউল, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য-প্রমাণাদি, সাক্ষীদের জবানবন্দি, আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, টেলিফোন কথোপকথন, ওয়্যারলেস কথোপকথন, বিভিন্ন সার্ভারে সংরক্ষিত ডাটা এবং জাতিসংঘের প্রতিবেদনসহ অজস্র ডিজিটাল প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়েছে।

বিচার প্রক্রিয়া এবং ‘গণহত্যা’ বনাম ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’:

চিফ প্রসিকিউটর জানান, তদন্ত প্রতিবেদন, তথ্য-প্রমাণাদি ও আলামত বিশ্লেষণ করে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেলে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে এই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আদালতে দাখিল করা হবে, যার মাধ্যমে বিচারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে।

বিচারের দ্রুততা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

দেশব্যাপী মানুষের মধ্যে চাহিদা আছে দ্রুত বিচার শুরু করার জন্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে বিচার, মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার, এটা কোনো সাধারণ বিচার নয়। রাজপথের চাপে বিচার করা সম্ভব হবে না। সেটা করতে গেলে বিচার সঠিকভাবে কখনো করা সম্ভব নয়… তাড়াহুড়া করতে গিয়ে যদি মামলাটা ফেইল করে তাহলে জাতির আকাঙ্ক্ষা কখনো পূরণ হবে না, ন্যায়বিচার করা হবে না। সে কারণে যতটুকু সময় প্রয়োজন ততটুকু সময় এই ট্রাইব্যুনালকে, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে দিতে হবে। আমরা চাই বিচারে কোনো রকম অনিয়ম, মানবাধিকার লঙ্ঘন না হোক। বিচারে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি না হোক, বিচার নিয়ে প্রশ্ন না উঠুক। বিচারটি সঠিক ও আইনসম্মত উপায়ে এমনভাবে হোক, যাতে আসামিপক্ষ কিংবা বাদীপক্ষ কেউই বলতে না পারে, বিচারটি সঠিক হয়নি। সে ব্যাপারটি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। এটা আমাদের অঙ্গীকার।

তদন্ত প্রতিবেদনে গণহত্যার অভিযোগ না থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে চিফ প্রসিকিউটর স্পষ্টভাবে বলেন:

এখানে (তদন্ত প্রতিবেদনে) গণহত্যার কোনো চার্জ নেই। কারণ আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার স্বীকৃত যে সংজ্ঞা, সেই সংজ্ঞার মধ্যে বাংলাদেশে যে অপরাধ হয়েছে তা মানবতাবিরোধী অপরাধ। গণহত্যার অপরাধ নয়। বাংলাদেশে যদি একসঙ্গে অনেক লোক মারা হয়, তখন আমরা বলি গণহত্যা হয়েছে। এটা মাসকিলিং বা ম্যাসাকার (ধ্বংসযজ্ঞ) বলতে পারেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনে যে জেনোসাইড সেটা কিন্তু এটা নয়… সেটা (গণহত্যা) হওয়ার জন্য যে ধরনের ক্রাইটেরিয়া পূরণ করা দরকার, সেটা নেই। বাংলাদেশে মাস কিলিং হয়েছে। দেড় হাজারের ওপর মানুষকে মারা হয়েছে। এটা একটা ম্যাসাকার। এটা ব্যাপক হারে হত্যা। কিন্তু এটা গণহত্যা নয়।

Author

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

সম্পর্কিত সংবাদ

Back to top button
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker