২০২৪ বিদায় নিল, শুরু হলো ২০২৫। গত বছরের চারটি মাস অন্তর্বর্তী সরকারকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে কী কী সংস্কার বা পরিবর্তন প্রয়োজন সেসব নির্ণয় এবং বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা রচনাতেই মূলত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। হয়তো নতুন বছরটিতে ওই সব সংস্কার/পরিবর্তন কাজের বাস্তবায়ন শুরু করাসহ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে হাত দিতে হবে। কারো পক্ষেই বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এই কাজগুলো যেমন জটিল প্রক্রিয়া, তেমনি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই বিরাজমান এবং আসন্ন পরিস্থিতিকে অনুভব করে বলা যায় যে ২০২৫ সালটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জিং বছর।
আমরা জানি, একটা দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থান সেই দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর অনেকটাই প্রভাব ফেলে। সেই বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের গত কয়েক মাস অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশি সময় ব্যয় করার কারণে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থান সংরক্ষণের প্রতি দৃষ্টি দিতেই দেখা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নেওয়া ছাড়াও ১৯ ডিসেম্বরে মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত একাদশ ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলন যোগ দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, এই সম্মেলনে বাংলাদেশ মিসরের কাছে ডি-৮-এর পরবর্তী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হস্তান্তর করে। বাংলাদেশ চেয়ারম্যান থাকাকালীন যে মাইলফলক অর্জন হয়েছিল তার মধ্যে ছিল ডি-৮ অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির অনুমোদন এবং ঢাকায় ডি-৮ যুব কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। শীর্ষ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ডি-৮ দেশগুলোতে যুবসমাজের মধ্যে উদ্ভাবন, উদ্যোক্তা এবং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য উদ্যোগের প্রস্তাবও করেন।দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে বলা যায় যে ২০২৫ সালে অভ্যন্তরীণ, বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সমীকরণে যেতে হতে পারে তা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করতে অন্তর্বর্তী সরকারের যে সম্পৃক্ততার প্রয়োজন পড়বে তা সামাল দিয়ে বৈদেশিক সম্পর্কের স্বাভাবিক গতিকে চলমান রাখাটাই হয়তো প্রাধান্য পাবে বলতে গেলে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব একটা প্রয়োজন না হলে অনেকটা রুটিন কার্যাবলির মধ্যেই চলার সম্ভাবনা। তবে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যাতে স্বাভাবিক থাকে সেদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে কয়েক দিন পূর্বে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু ছাড়াও দুই দেশ ও তাদের জনগণের মধ্যে সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয় এবং দুই দেশের স্বার্থেই সুসম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা গুরুত্ব পায়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে শুধু দুই দেশেরই স্বার্থেই নয়, এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশ সেদিকে অবশ্যই লক্ষ রাখবে বলেই আমরা আশাবাদী। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রেসিডেন্ট বাইডেন ক্ষমতায় থাকাকালীন যে রকমটি ছিল, নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প আগামী ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পর সেই সম্পর্কের তেমন বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশগুলোর সম্পর্ক বিবেচনায় হয়তো বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামান্য যোগ-বিয়োগ হতে পারে এবং সেটি হতে পারে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার এই পরিবর্তনটি যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ঘটতে যাচ্ছে, তাই সময় থাকতেই নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদার করার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বছরটি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিগত কয়েক মাসের ধারাবাহিকতায়ই চলার সম্ভাবনা। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্তিশালী তখনই হয় যখন উভয়ের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রটি শুধু সম্পূর্ণভাবে নিরাপদেই থাকে না, তা সম্প্রসারিত এবং নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠে। রাশিয়ার বা চীনের বাংলাদেশে যে বিনিয়োগ রয়েছে এবং বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে সম্পৃক্ততা চলমান তা অব্যাহত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে আগামী দিনগুলোতে। অন্যদিকে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই দুটি দেশ বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক যাতে আরো ঘনিষ্ঠ হয় বর্তমান সরকার অবশ্যই সেদিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখবে বলে বিশ্বাস।বাংলাদেশ সব সময়ই একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে প্যালেস্টাইনে চলমান ইসরায়েলি নৃশংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনে শান্তি স্থাপনের জন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এমনকি মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা কায়রো ডি-৮ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের মানবিক হস্তক্ষেপের বাইরে গিয়ে গাজা, পশ্চিম তীর এবং লেবাননের পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের প্রতি বাংলাদেশের অটল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন এবং অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান। তিনি সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান, যুদ্ধাপরাধের জবাবদিহি এবং ১৯৬৭-পূর্ব সীমান্তের ভিত্তিতে আল-কুদস আল-শরিফকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর ফিলিস্তিনের রাজধানী করে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন। তিনি গাজা ও লেবাননের পুনর্গঠন ব্যয় অনুমান করার জন্য এবং সম্পদ সংগ্রহের জন্য আন্তর্জাতিক কৌশল প্রণয়নের জন্য একটি ডি-৮ নেতৃত্বাধীন প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তাব করেন।বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে প্রত্যাবাসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই রইল। মায়ানমার সরকারের ছলচাতুরীতে আগের সরকারের প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখেনি, দিনক্ষণ ঠিক করে একজন রোহিঙ্গাকেও মায়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সমর্থন সত্ত্বেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়াটি দিনের আলো দেখতে পায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের বিগত মাসগুলোতে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। বরং মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির চলমান সংঘাতে এরই মধ্যে বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। আগামীতে এদের বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ করতে না পারলে আবার কয়েক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুলতে হবে বাংলাদেশকে। তেমনটি হলে নিঃসন্দেহে সেটি বাংলাদেশকে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, নিরাপত্তার জন্যও হুমকিতে ফেলবে। এ ক্ষেত্রে ২০২৫ সালটি এ সরকারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকবে। এই সমস্যার সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকার তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে কি না জানি না। কারণ এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতা ডিঙানো এ মুহূর্তে সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এদের তৃতীয় দেশে প্রত্যাবাসনের চিন্তাভাবনা করে দেখা যেতে পারে।বিগত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। এ সময় প্রতি মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাওয়া গেছে। রেমিট্যান্সের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে হয়তো তা ২৬-৩০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়াতে পারে। তবে রেমিট্যান্সের এই প্রবৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে আমাদের অভিবাসীদের মধ্যে সরকারি মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রেরণের সচেতনতা সৃষ্টি। অন্যদিকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ প্রেরণে তাদের আগ্রহের কমতি। তবে রেমিট্যান্স আরো কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব যদি অভিবাসন ব্যয় কমানো যায় এবং সবাইকে বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো যায়। সরকার এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে অভিবাসীবান্ধব প্রক্রিয়ায় কর্মী পাঠানোর কথা ভাবতে পারে।দেশে গত কয়েক মাসে আমাদের তৈরি পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে কয়েকটি কারণে, বিশেষ করে শ্রমিকদের অসহযোগিতা বা ধর্মঘটের ফলে। অনেক কারখানায়ই উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানি বড় ধরনের হুমকিতে পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সরকার কাজ করছে এবং আশা করা যায় যে আগামীতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে সরকার সজাগ থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে হবে যেন আমাদের রপ্তানি আয় কমে না যায়। তা ছাড়া বৈদেশিক বিনিয়োগ যেন নিম্নগামী ধারা থেকে উঠে আসতে সক্ষম হয় সে জন্য এই ক্ষেত্রটিকে আরো আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। অন্যদিকে যেসব বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে তাদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের বিরূপ মনোভাবের বা শঙ্কার সৃষ্টি না হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী রাখতে হলে এসব ক্ষেত্রের প্রতি যত্নবান হতে হবে, প্রয়োজনীয় কার্যক্রম বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে, তাদের আস্থার নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটিকেও শক্তিশালী ও জনমুখী করার আবশ্যকতা রয়েছে।শুধু প্রতিবেশী ও এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি দেশের এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে আরো অর্থবহ, বাস্তবমুখী ও পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তিশালী, বহুমুখী ও সম্প্রসারিত হোক সে প্রত্যাশাই রইল।